নিজের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার ব্যাংকের গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের সাংসদ বিএইচ হারুনের (বজলুল হক হারুন) বিরুদ্ধে।
ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে গ্রাহকের নামে অতিরিক্ত চেক বই ইস্যু দেখিয়ে জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ও ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের ভগ্নিপতি বিএইচ হারুন একই ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রুমী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী খলিলুর রহমানের দাবি, এই টাকার মালিক তিনি। বিএইচ হারুন আত্মসাতের কথা অস্বীকার করলেও হঠাৎ করে বিপুল সম্পদ বাড়ার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
খলিলুরের এক অভিযোগ তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, চেক বই ইস্যু রেজিস্টার ও কার্ডে রক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের সঙ্গে অনেক চেকের পাতায় দেওয়া গ্রাহকের স্বাক্ষরের মিল নেই। স্বাক্ষর না মিললে টাকা পরিশোধ করা যায় না। কিন্তু প্রিমিয়ার ব্যাংক কেন করল, তা বোধগম্য নয়।’
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকে আমানত ছয় লাখ ৬২ হাজার, বাড়ি বা দোকানভাড়া থেকে আয় ১৬ লাখ, ব্যবসা থেকে আয় ১৪ লাখ এবং সম্মানী বাবদ আয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা দেখিয়েছিলেন। স্ত্রীর নামে তখন কিছুই ছিল না। এবারও ঝালকাঠি-১ আসন থেকে নির্বাচিত এই সাংসদ হলফনামায় দেখান, নিজের ও স্ত্রীর মিলিয়ে ১৫ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া নগদ দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ৬৭ লাখ টাকা, ব্যাংকে এফডিআর তিন কোটি ৬৮ লাখ টাকা, গাজীপুরে ১৭ কাঠা, মিরপুরে পাঁচ কাঠা, বনানীতে সাড়ে ছয় কাঠা, বারিধারায় ছয় কাঠার একটি ও সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর আরেকটি বাড়ি কিনেছেন।
হলফনামায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে নয় কোটি ৫৯ লাখ টাকা, স্ত্রীর কাছ থেকে তিন কোটি ২০ লাখ এবং বৈদেশিক মুদ্রায় এক কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণ দেখিয়েছেন তিনি দায় হিসেবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মার্কিন দূতাবাসসংলগ্ন বারিধারার সাড়ে চার কাঠার প্লটে নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনের নয়তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। ভবনের গায়ে ব্যানার টানানো ‘প্রিমিয়ার ব্যাংকের বারিধারা শাখার উদ্বোধন শিগগিরই’। আর বনানীর প্লটে আটতলা ভবন তৈরির কাজ করে দিচ্ছে ডেভেলপার কোম্পানি এএনজেড প্রোপার্টিজ।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে সৌদি সরকারের সাহায্যে উপকূলীয় অঞ্চলে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য ১৫ হাজার ঘর নির্মাণের ২০৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিলেন খলিলুর। এ থেকে ৭০ কোটি টাকা তুলেছেন তিনি। বাকি অর্থই আত্মসাৎ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একই বিষয়ে তদন্ত করে জালিয়াতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান এম বদিউজ্জামান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জালিয়াতির আলামত দেখা যাচ্ছে। তবে তদন্ত চলমান। আগে তদন্ত শেষ হোক, তার পর কথা বলব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের নির্দেশে গত নভেম্বরে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের আওতায় আরেকটি তদন্ত দল কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু তদন্ত শুরুর পরদিনই ডেপুটি গভর্নর সীতাংশুকুমার সুর চৌধুরীর একটি ফোনে এর কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সীতাংশুকুমার সুর চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফালতু কথা। তদন্ত আমি স্থগিত করিনি। তদন্ত আগে একবার হয়েছে, প্রয়োজনে আবার হবে।’
জানা গেছে, ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খন্দকার ফজলে রশীদের সময়কালীন এই সুপরিকল্পিত জালিয়াতি চাপা দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন বর্তমান এমডি কে এম মাজেদুর রহমান। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) আবু হানিফ খান, বংশাল শাখার ব্যবস্থাপক সামসুদ্দিন চৌধুরী, বিএইচ হারুনের মালিকানাধীন আল হোমায়রা মেডিকেল সেন্টারের দুই হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা রাজা ও ফরিদ উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনার সহযোগী।
গত ২২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর বনানীতে আল হোমায়রা মেডিকেল সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় বিএইচ হারুনের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী কথা হয় এই প্রতিবেদকের। টাকার অঙ্কের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘খলিলুরের মতো লোক এত টাকা পাবে কই?’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০০৮ সালের ৩ জুলাই থেকে ২৬ অক্টোবর সময়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের বংশাল শাখায় খলিলুর রহমান সাতটি চেকে ২০৪ কোটি টাকা জমা করেছেন।
পরিকল্পিত জালিয়াতি: বিএইচ হারুন ও খলিলুর—দুজনেরই অফিস বনানীতে। ২০০৮ সালের ২ জুলাই বংশাল শাখায় একটি হিসাব খোলেন খলিলুর। এ বিষয়ে খলিলুর বলেন, ‘বনানী শাখায় হিসাব খুললে এইচ বি এম ইকবালকেও মুনাফার ভাগ দিতে বিএইচ হারুন এই বলে আমাকে ভয় দেখান। তাই বংশাল শাখায় হিসাব খুলি।’
হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ৩ জুলাই থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত খলিলুরের হিসাবে ৬৮৫টি চেকের মাধ্যমে ২০৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। কিন্তু খলিলুরের দাবি, তিনি ৩০০টি চেকের পাতা নিয়ে ২৯৭টির মাধ্যমে ৭০ কোটি টাকা তুলেছেন। তাঁর নামে অতিরিক্ত ৩৮৮টি চেক ইস্যু দেখিয়ে বাকি টাকা বিএইচ হারুন তুলে নিয়ে গেছেন। বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশির ভাগ টাকা তোলা হয়েছে ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বনানী শাখা থেকে বিএইচ হারুনের আল হোমায়রা মেডিকেলের দূরত্ব ৫০ গজ।
বিএইচ হারুন বলেন, ‘এই যুগে কি একজনের টাকা আরেকজনের স্বাক্ষরে তোলা সম্ভব?’ এএমডি আবু হানিফ বলেন, এত আগের ঘটনা মনে নেই। খলিলুরের স্বাক্ষরিত চেকেই সব টাকা উঠেছে বলে দাবি তাঁর। বংশাল শাখার ব্যবস্থাপক সামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। সব জানে প্রধান কার্যালয়।’
এমডি কে এম মাজেদুরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে দেখা যায়, ‘খলিলুরের কাছে ব্যাংক টাকা পায়। তা না দিতে ব্যাংকের সুনাম নষ্ট করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তিনি।’
রুমী এন্টারপ্রাইজ একটি একক মালিকানা প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটির আগে চার কোটি টাকা ঋণ ছিল প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখায়। ওই টাকা বংশাল শাখা থেকে সমন্বয় করতে ২০০৮ সালের ৫ ও ২৬ অক্টোবর দুই দফা আবেদন করলেও ব্যাংক তা করেনি।
খলিলুর বলেন, ‘এর পরই আমার খটকা লাগে। নভেম্বরে আমি বংশালের ব্যবস্থাপকের কাছে হিসাব বিবরণী চাই। তিনি জানান আমার হিসাব বন্ধ এবং এতে কোনো টাকা নেই।’ এরপর বিএইচ হারুন ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সালিসের নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে বলে জানা গেছে। সালিসের নেতৃত্ব দেন আবু হানিফ খান।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ৬ জুন থেকে বংশালের ব্যবস্থাপক সামসুদ্দিনের কাছে খলিলুর হিসাব বিবরণী ও চেক বইয়ের জন্য ১৫ বার আবেদন করলেও কোনো জবাব পাননি তিনি। পরে জানানো হয়, এই ব্যাংকে হিসাব বন্ধের জন্য খলিলুর নিজেই ২০০৮ সালের ৫ নভেম্বর আবেদন করেছিলেন। আর হিসাব খোলার চার দিন পর অর্থাৎ ৬ জুলাই আবেদন করেছিলেন, স্বাক্ষর না মিললেও যাতে টাকা দেওয়া হয়। খলিলুর এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জঘন্য মিথ্যাচার।’
নিজের দায় অন্যের ঘাড়ে: ২০১২ সালের ৫ জুলাই খলিলুর ও তাঁর স্ত্রী পারভীন বেগমসহ আরও কয়েকজনের নামে আইনি নোটিশ দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। খলিলুরের দাবি, যে ঋণের জন্য এ নোটিশ, তার দায় মূলত বিএইচ হারুন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের।
রুমী এন্টারপ্রাইজের ঋণের বাইরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছিল গুলশান শাখায়। এ ঋণের মূল গ্রহীতা বিএইচ হারুন ও তাঁর আত্মীয়স্বজন। কয়েকটিতে অন্য অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত জামিনদার ছিলেন খলিলুর। খলিলুর বলেন, ‘নিজের ব্যাংক থেকে বেনামে ঋণ নিলেন বিএইচ হারুন। আমি ছিলাম জামিনদার। এই কারণে আমার ওপর দায় চাপানো হলো।’
যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, ২০০০ সালের মাঝামাঝি কাজী ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়, যার চেয়ারম্যান বিএইচ হারুন ও পরিচালক তাঁরই ভাই মজিবুল হক কামাল। এ ছাড়া হারুনের বন্ধু কাজী নাসিরউদ্দিন বাবুল, তাঁর স্ত্রী মেহেরুন্নেসা বেগম এবং তাঁদের দুই ছেলে কোম্পানির পরিচালক।
২০০৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিএইচ হারুন ও তাঁর ভাই নাম প্রত্যাহার করে পরিচালক নিয়োগ করেন তাঁদের বোনের ছেলে হাসিবউদ্দিন, হারুনের স্ত্রীর মৃত ভাই শাহ আলমের স্ত্রী ইলিজা রহমানকে।
জানা গেছে, নিজ ব্যাংক থেকে নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ পাচ্ছিলেন না বলে এ সময় কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেন বিএইচ হারুন। প্রিমিয়ার ব্যাংক এগুলোর নামে জামানত ছাড়াই ঋণ দেয় ৭০ কোটি টাকা এবং প্রতিটিরই চেক বই থাকে বিএইচ হারুনের কাছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে: রুমী এন্টারপ্রাইজ, ইস্টার্ন বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েট, সেলিম এন্টারপ্রাইজ, রাজ অ্যান্ড ব্রাদার্স, আরইকে আইসিএল, মেসার্স জাহিদুল ইসলাম ফারুক, জাহিদ-রুমী কেআইসিএল, পিটিএসএল-আরইকে আইসিএল ইত্যাদি।
পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে খলিলুর বর্তমানে জীবনের ঝুঁকিতে রয়েছেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনিসহ ১৪ জনের নামে মামলা করা হয়েছে। ব্যাংকের কর্মকর্তা পরিচয়ে হুমকি দিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হচ্ছে খলিলুরকে। বনানী ও গুলশান থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তিনি।