
দেশজুড়ে হিন্দুদের মন্দির–মণ্ডপ ও বসতবাড়িতে হামলার প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী শহীদ আলীম চৌধুরীর কন্যা নুজহাত চৌধুরী বলেছেন, ঘরের ভেতর বিভীষণ ঢুকে গেছে। যারা সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে দেশকে মিনি পাকিস্তান করতে চায়, তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের ভেতর ঢুকে গেছে।
আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সম্প্রীতি সমাবেশে এ কথা বলেন নুজহাত চৌধুরী। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টার প্রতিবাদে সম্প্রীতি বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত এই সমাবেশে ৮৯টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ও ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হাজার বছরের সেই সংস্কৃতি ধ্বংসের চক্রান্ত করছে। সম্প্রীতির বাংলাদেশকে রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব অসাম্প্রদায়িক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভেঙে দিতে হবে সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত।
শহীদ বুদ্ধিজীবীকন্যা নুজহাত চৌধুরী একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, ‘আজন্ম ও সহস্র বছর ধরে বাঙালি অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। এই দেশের প্রতিটি ইঞ্চিতে রক্ত ঢেলে আমরা তা প্রমাণ করেছি। আমাদের ঘরের ভেতর বিভীষণ ঢুকে গেছে। সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে যারা দেশের উন্নয়নের গতিপথকে রুদ্ধ করতে চায়, দেশকে যারা মিনি পাকিস্তান করতে চায়, তাদের কেউ কেউ আমাদের ভেতর ঢুকে গেছে। এদের চিহ্নিত করতে হবে।’
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোকে একধরনের রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা বলে মনে হয়েছে। তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে অসাম্প্রদায়িক-মানবিক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষগুলোকে সহমত জ্ঞাপন করে এক মঞ্চে আসতে হবে। এই অপশক্তি অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসে না। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্ব তথা জনপ্রতিনিধিদের অনেক দায়িত্ব আছে। যেখানে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, সেখানেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ওপর হামলা’ বলে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব কামরুল হাসান খান। তিনি বলেন, ‘সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হামলা আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হতে পারে। আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে এসব হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব। সহিংসতার ঘটনায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাঁদের পুনর্বাসনও করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, সম্প্রীতির বাংলাদেশের জন্য তা দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। এসব ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, ‘সংখ্যালঘু বলে শব্দ থাকতে পারে না। সবার আগে আমরা বাঙালি। এরপর আমরা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ নাকি খ্রিষ্টান, সেটি হবে আমাদের উপাসনালয়ের পরিচয়। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশকে কেউ আফগানিস্তান-পাকিস্তান বা ইরাকে পরিণত করতে চাইলে তাদের আমরা রাজপথে মোকাবিলা করব।’
সুয়াবিল সিদ্ধাশ্রম মঠের অধ্যক্ষ স্বামী দেবানন্দ মহারাজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার দাবি করে বলেন, এসব ঘটনা শহীদদের মহিমা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে খর্ব করে। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে, অন্যায় কাজ করে, তারা কোনো ধার্মিক ব্যক্তি নয়, তারা দুষ্কৃতকারী।
বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, ‘দেশে পরমতসহিষ্ণুতা রক্ষায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কুমিল্লার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ইকবাল হোসেনের গডফাদারদের এবং সাম্প্রদায়িক হেফাজতি-জামায়াতি অপশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।’ কমলাপুর রেলস্টেশন জামে মসজিদের খতিব মুফতি বোরহানউদ্দীন আল আজিজি বলেন, ‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এই দেশে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে। মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইসলামেরই শিক্ষা।’
ব্যাপটিস্ট চার্চ সংঘের সভাপতি রেভারেন্ট মার্টিন অধিকারী বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাঙালি জাতিসত্তার ওপর মস্ত বড় আঘাত। মানুষের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে মনুষ্যত্ব। বাংলাদেশে সেই প্রকৃত ধর্ম আজ লুণ্ঠিত ও পদদলিত হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আজকে লড়াই করতে হবে।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলার আহ্বান জানান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিএফইউজের একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা জাতির গৌরব ও অহংকারকে কলঙ্কিত করেছে। বর্তমান সরকারের ইমেজ ধ্বংসের জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা মাঠে নেমেছে। এদের প্রতিহত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হবে। সব সমস্যার সমাধান বাহাত্তরের সংবিধান।
প্রজন্ম ’৭১ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি আসিফ মুনীর বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন লাগবে। বাংলাদেশবিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে যেমন প্রতিহত করতে হবে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়েও প্রতিহত করতে হবে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ‘পুড়ে যাওয়া বন্ধনকে’ ফের জোড়া লাগানোর আহ্বান জানান জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা। হলটির সাবেক প্রাধ্যক্ষ অসীম কুমার সরকার বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বাংলাদেশের হাজার বছরের সম্প্রীতির সংস্কৃতি ধ্বংসের চক্রান্ত করছে এবং কিছু অপকর্ম ঘটিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, তাদের সংখ্যা কম, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বেশি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ালে এই দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষদাঁত আমরা ভেঙে দিতে পারব। ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
সমাবেশ থেকে সরকারের কাছে সাত দফা দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি, অতীতের ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে প্রশাসনের আরও বেশি তৎপরতা, সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও উপাসনালয় দ্রুত সংস্কার, মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, আবহমান বাংলার সংস্কৃতিচর্চায় তরুণ ও যুবসমাজকে অধিকতর সম্পৃক্ত করতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও উসকানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্যসচিব মামুন আল মাহতাবের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী, শিক্ষক সমিতির সদস্য চন্দ্রনাথ পোদ্দার, মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাস, খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব উইলিয়াম প্রণয় সমাদ্দার, বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মহাসচিব পি আর বড়ুয়া, বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি প্রসেনজিৎ বড়ুয়া, পূজা উদ্যাপন পরিষদের সহসভাপতি জে এল ভৌমিক প্রমুখ বক্তব্য দেন।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে এই সমাবেশে সংহতি জানান বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান শরীফ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে সংহতি জানান আওয়ামী লীগ নেতা নুরুন নবী।