আসকের মানবাধিকার প্রতিবেদন: রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত ৫০৭ জন

চরম উদ্বেগের বছর ২০১৩

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গতকাল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৩ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকেরা ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গতকাল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৩ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকেরা ছবি: প্রথম আলো

সদ্যবিদায়ী বছরটিতে (২০১৩ সাল) দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। বছরব্যাপী চলতে থাকা রাজনৈতিক সংঘাতে ৫০৭ জন নিহত হয়েছেন। গুম বা গুপ্তহত্যার শিকার হন ৫৩ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় ৭২টি। দায়িত্ব পালনকালে মারা গেছেন তিনজন সাংবাদিকও।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৩ তে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে আসক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলনে আসকের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয় করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আসকের নিজস্ব অনুসন্ধানের তথ্যও আছে। এক প্রশ্নের উত্তরে নূর খান বলেন, ৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনার পরিস্থিতির কারণে আসক অনুসন্ধান করতে পারেনি।
সহিংসতা: যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় ও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৮৪৮টি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ১৮-দলীয় জোটের লাগাতার হরতাল-অবরোধে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা; বিশেষত ককটেল ও বোমা বিস্ফোরণ, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ এবং ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চরম আকার ধারণ করে। অন্যদিকে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধাদান, জামায়াত-শিবিরের মিছিলে গুলি, গণগ্রেপ্তার ও আটকের ঘটনা সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এসব ঘটনায় ৫০৭ জন নিহত ও ২২ হাজার ৪০৭ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৫ জন পুলিশ ও দুজন বিজিবির সদস্য।
গুপ্তহত্যা: আসকের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা আবু আহমেদ ফয়জুল কবিরের উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর গুম বা গুপ্তহত্যার শিকার হন ৫৩ জন। অপহরণ, গুম, নিখোঁজ বা গুপ্তহত্যার প্রায় সব ঘটনায় দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন জোর করে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক দিন ধরে তিনি নিখোঁজ থাকেন, পরে হয়তো কারও লাশ উদ্ধার হয়।
ইতিবাচক: প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ক্ষেত্রে দেশে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতিদান, শিশু আইন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইন, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, জাতীয় নদী রক্ষা আইন প্রণয়ন মানবাধিকার রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক ঘটনা।
বিচারবহির্ভূত হত্যা: আসক বলছে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার করেছিল। বাস্তবে তা বন্ধ হয়নি। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় ও এনকাউন্টারে ৭২ জন মারা যায়।
গণমাধ্যম: গত বছর রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে তিনজন সাংবাদিক নিহত ও ২৮০ জন আহত হন। নিহতরা হলেন: দৈনিক জন্মভূমির দেবহাটা উপজেলা প্রতিনিধি আবু রায়হান; সাপ্তাহিক অপরাধ দমনের যুগ্ম সম্পাদক দুর্জয় চৌধুরী এবং দৈনিক প্রথম ভোরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফারহান রাজা। সরকার আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির প্রচার বন্ধ করে দেয়।
সংখ্যালঘু: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায়কে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৭৮টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ; ২০৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর এবং ৪৯৫টি মন্দির, উপাসনালয় ও প্রতিমা ভাঙচুর হয়। আহমদিয়া মুসলিম জামাতের ওপরও হামলা-নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে। আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, জমিদখল ও নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে।
নারী নির্যাতন: গত বছর ৮১২ জন নারী ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণ-পরবর্তী ৮৭ জনতে হত্যা করা হয়। আত্মহত্যা করেন ১৪ জন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়ন ও নারী উত্ত্যক্তকরণের বহু ঘটনা ঘটে। ৭০৩ জন নারী পারিবারিক নির্যাতন ও ২১ জন ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন।
২০১৩ সালের সবচেয়ে বিপর্যয়কর ছিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনা। ৪ এপ্রিলের ওই ঘটনায় পাঁচটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক আহত হন।