শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন

চরের জীবনে দুধের সম্ভার

গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন বেড়ার চরনাকালিয়া গ্রামের আনিসুর রহমান। অভাব একটা সময় ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। গরু পালনের মাধ্যমে তিনি এখন সচ্ছল l ছবি: প্রথম আলো
গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন বেড়ার চরনাকালিয়া গ্রামের আনিসুর রহমান। অভাব একটা সময় ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। গরু পালনের মাধ্যমে তিনি এখন সচ্ছল l ছবি: প্রথম আলো

পাবনার বেড়া উপজেলার চরনাকালিয়া গ্রামের ইয়াছিন আলী। নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে ফেরি করে হাঁড়িপাতিল বিক্রি করতেন তিনি। প্রতিদিন ১০০ টাকার বেশি আয় হতো না। প্রায় ১৫ বছর আগে একটি বকনা বাছুর কেনেন তিনি। সেই বাছুরটিই আজ তাঁর ভাগ্য বদলে দিয়েছে। গোয়ালে তাঁর এখন ছয়টি উন্নত জাতের গাভি। দুই লাখ টাকা খরচ করে একটি ঘর দিয়েছেন। কিছু জমিও করেছেন। সব মিলিয়ে এখন তাঁর প্রায় দশ লাখ টাকার সম্পদ আছে।
সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গেলে নতুন ঘরটি দেখিয়ে ইয়াছিন আলী বললেন, ‘এরম একটা ঘরে পরিবারের লোকজন নিয়্যা থাকপ্যার পারব, তা কুনুদিনও ভাবি নাই। এই গরুগুল্যার জন্নেই আইজ আমার এরম অবস্থা।’
আরেক জনের গল্প শুনুন। নদীভাঙনে নিঃস্ব আলম প্রামাণিকের বসতভিটা পর্যন্ত ছিল না। ভাঙনদুর্গত আরও অনেক মানুষের সঙ্গে তিনি বেড়া উপজেলার যমুনার চর চরনাকালিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। অন্যের জমিতে দিনমজুরি খেটে ও বর্গাচাষি হিসেবে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। আলম প্রামাণিকের ১৫ বছর আগে অবস্থা ছিল এ রকম। আর আজ?
আজ তাঁর ঘরবাড়ি, জমিজমা—সব হয়েছে। এলাকায় তিনি এখন অন্যতম একজন সচ্ছল মানুষ। সব মিলিয়ে তাঁর সম্পদের দামও অন্তত ১০ লাখ টাকা।
কেমন করে বদলাল তাঁর অবস্থা? উত্তরে বললেন, ‘আমার ভাগ্য বদলায়া দিছে গরু। এনজিওর ঋণে দুইড্যা বকনা বাছুর কিনছিল্যাম। আইজ আমার গোয়ালে ছয়ডা গাভি। দৈনিক দেড় মণ দুধ পাই। এহন গরু পালনই আমার প্রধান পেশা।’
এই গ্রামের বাসিন্দা আনিসুর রহমান। অভাব একটা সময় ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। গরু পালনের মাধ্যমে তিনিও এখন সচ্ছল।
ইয়াছিন আলী, আলম প্রামাণিক ও আনিসুর রহমানের মতো গরু পালন করে অবস্থা বদলের অনেক কাহিনি শুনতে পাওয়া যায় বেড়ার চরাঞ্চলে গিয়ে। বন্যা আর নদীভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটানো চরবাসীর জীবনে অর্থনৈতিক দুর্দশা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। তবে গরু লালন-পালনের মধ্যে দিয়ে দৈন্যদশা ঘুচে সচ্ছলতা এসেছে তাদের জীবনে।
যমুনাপাড়ের নাকালিয়া বাজার বেড়ার প্রায় ১৫টি চরের মানুষের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এই বাজারের ঘাটে কথা হয় চরসাঁড়াশিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ওয়ার্কার্স পাটির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁর মতে, ১৫ বছর আগেও চরে এত গরু ছিল না। ওই সময় হাতে গোনা কয়েকজন গৃহস্থ উন্নত জাতের গাভি এনে পালন শুরু করেন। অনেকে আবার এঁড়ে বাছুর কিনে পালন করতে থাকেন। গাভির দুধ ও গরু মোটাতাজা করা থেকে ভালো লাভ হতে দেখে গরু পালনে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন চরের প্রায় বাড়িতেই গড়ে উঠেছে গরুর খামার। নজরুল ইসলাম বলেন, চরে গরু পালনের হিড়িক পড়েছে। অন্তত ৯০ ভাগ মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে।
পরে কথা হয় চরসাঁড়াশিয়ার আবদুল আউয়াল শেখ, চরনাকালিয়ার ইউসুফ আলী, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলার ইব্রাহিম হোসেনসহ বিভিন্ন চরের ১০ থেকে ১৫ জনের সঙ্গে। গরু পালনের মাধ্যমে তাঁরা সুখের দেখা পেয়েছেন বলে দাবি করেন। সবার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নজরুল ইসলামের তথ্য পুরোটাই ঠিক।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে দেশের প্রধান দুগ্ধ উৎপাদনকারী ও গরু পালনকারী এলাকা গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় এ এলাকায় গরু পালনে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে চর এলাকায় গরু পালনের খরচ অন্য এলাকার তুলনায় অনেক কম বলে চরে গরু পালনের হার বেশি।
চরবাসী জানান, মূল এলাকায় সারা বছর গো-খাদ্য কিনে গরুগুলোকে খাওয়াতে হয়। কাঁচা ঘাস কম পাওয়া যায় বলে খড়-ভুসির ওপর গরু পালনকারীদের নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্তু চরে বর্ষার মাস চারেক ছাড়া বাকি সময় পাওয়া যায় প্রচুর কাঁচা ঘাস। বিনা খরচেই চরবাসী এই ঘাস সংগ্রহ করেন। ফলে গরু পালনের বার্ষিক খরচ অন্য এলাকার চেয়ে প্রায় অর্ধেক কমে আসে। উপরন্তু, কাঁচা ঘাস বেশি খাওয়ার জন্য গাভিগুলো দুধও দেয় বেশি।
সরেজমিনে একদিন: চরপেঁচাকোলা, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা, চরনাকালিয়া, চরনাগদা, চারসাঁড়াশিয়া, চরহাটাইল আড়ালিয়া, চরসাফুল্যা, চরআগবাগসোহা, চরকল্যাণপুর, ঢালারচরসহ বেড়ার সব চরই এখন গরু পালনের জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। চরগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব ১৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। সম্প্রতি সরেজমিনে দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা, চরনাকালিয়া, চরনাগদা ও চরসাঁড়াশিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় বাড়িতেই রয়েছে গরুর ছোট ছোট খামার। সকালবেলায় চলছে দুধ দোহনের তোড়জোড়। ব্যতিব্যস্ত দুধ ব্যবসায়ী (ঘোষ) ও দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। প্রতিটি বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে বিশেষ ধরনের পাত্রে ভরে পাত্রগুলো ঘাটে ভেড়ানো নৌকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দুধের পাত্রে বোঝাই হতেই নৌকাগুলো ছুটতে থাকে উপজেলা সদরের দিকে।
কাজের ফাঁকে চরসাঁড়াশিয়া গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল জানান, তিনি সকাল ও বিকেল মিলিয়ে প্রতিদিন চর থেকে ২৫ মণের বেশি দুধ সংগ্রহ করেন। সেগুলো দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ ও ব্র্যাকের (আড়ং দুধ) শীতলীকরণ কেন্দ্রে সরবরাহ করেন। তিনি জানান, তাঁর মতো কমপক্ষে ২০ জন ব্যবসায়ী চর থেকে দুধ সংগ্রহ করে ব্র্যাক, আকিজ, প্রাণসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। এ ছাড়া ছানা তৈরির কারখানার অনেক লোক এসেও দুধ নিয়ে যান।
যমুনাপাড়ের পেঁচাকোলাঘাটে সকাল ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, দুধ নিয়ে আসা একটি নৌকা থেকে আট থেকে দশটি রিকশা-ভ্যানে দুধভর্তি পাত্রগুলো বোঝাই করা হচ্ছে। ভ্যানচালক আসাদুজ্জামান জানান, এই পেঁচাকোলাঘাটেই প্রতিদিন দুধ নিয়ে পাঁচ থেকে সাতটি নৌকা আসে। এ ছাড়া ডাকবাংলোঘাট, মোহনগঞ্জঘাট, নাকালিয়া বাজারঘাট, নগরবাড়ীঘাট প্রভৃতি ঘাটেও দুধ নিয়ে অনেক নৌকা আসে। একটি নৌকার মাঝি আবদুর রহমান জানান, ১২ থেকে ১৫টি নৌকা প্রতিদিন চর থেকে দুধ আনার কাজ করে।
গরু নিয়ে সুখী তাঁরা: দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা গ্রামের আতিয়ার হোসেনের একসময় কিছুই ছিল না। এখন গ্রামের বাজারে বড় একটি মুদি দোকান দিয়েছেন তিনি। দোকান দিতে যে চার-পাঁচ লাখ টাকা লেগেছে, তা পেয়েছেন গরু পালন করে। তাঁর খামারে চারটি গাভিসহ গরুর সংখ্যা ১০টি। প্রতিদিন গাভিগুলো থেকে তিনি ৫০ লিটার দুধ পান, যার দাম প্রায় দুই হাজার টাকা। এলাকায় এখন তিনি অন্যতম একজন সচ্ছল মানুষ।
চরের দুধ যেখানে যাচ্ছে: পাবনা-সিরাজগঞ্জের কয়েক উপজেলা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং দুধ, প্রাণ, ফার্মফ্রেস, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ কয়েকটি দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন প্রায় চার লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে থাকে। এই দুধের অন্তত ৫০ হাজার লিটার চর থেকে আসে বলে স্থানীয় পশুসম্পদ কার্যালয় ও কয়েকটি দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান জানায়। এ ছাড়া চরের গাভির প্রচুর দুধ যাচ্ছে আশপাশের ছানা তৈরির কারখানা ও মিষ্টির দোকানে।
হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের পেঁচাকোলা থেকে নাকালিয়া পর্যন্ত যমুনাপাড়ের শুধু এক কিলোমিটার অংশেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি শীতলীকরণ ও সংগ্রহ উপকেন্দ্র। প্রাণ ডেইরির সহকারী মহাব্যবস্থাপক শরীফউদ্দিন তরফদার জানান, পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চল থেকে প্রতিদিন তাঁরা প্রায় এক লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। এর প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধ আসে বেড়ার চরাঞ্চল থেকে।
বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হারুনূর রশীদ বলেন, চরে গরু পালন লাভজনক। তাই সেখানে গরু পালন দিন দিন বেড়ে চলছে।
হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চাঁদ প্রামাণিক বলেন, ‘ভাঙনকবলিত এলাকা বলে আমার ইউনিয়নের বেশির ভাগ চরবাসী কয়েক বছর আগেও ছিল বেশ অভাবী। কিন্তু গরু পালনের মাধ্যমে তাদের কপাল খুলতে শুরু করেছে। তাদের এভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প আমি অন্য এলাকার মানুষদের শোনাই।’