চার-পাঁচটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে আগ্রহ চিকিৎসকদের

এমবিবিএস পাস করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য হাতে গুনে চার-পাঁচটি বিষয়কেই বেছে নিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ফলে একদিকে যেমন রোগীরা ভালো চি​কিৎ​সা পাচ্ছেন না, চিকিৎ​সা ব্যয়বহুল হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক পাচ্ছে না। 

দেশে মোট ৩০টি প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতকোত্তর মেডিকেল ডিগ্রি দেওয়া হয়। উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানে দুটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস)। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসকেরা মেডিসিন, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, শিশু (মেডিসিন) ও জেনারেল সার্জারিতে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী। মৌলিক বিজ্ঞানের আটটি বিষয়, ফরেনসিক মেডিসিন ও সার্জারির বিভিন্ন জটিল শাখা, রক্তরোগ, হেপাটোলজির মতো বিষয়গুলোয় তাঁরা খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
বিএসএমএমইউ ও বিসিপিএস শল্যচিকিৎসা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি দিয়ে থাকে। বিএসএমএমইউতে সার্জারি অনুষদের অধীনে বিভাগ আছে ১৭টি, এর ১৪টি অস্ত্রোপচারনির্ভর। এ বছরের মার্চে ওই অস্ত্রোপচারনির্ভর বিষয়গুলোয় স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তিতে অংশ নেন ১ হাজার ৬৭৩ জন। আর অবেদনবিদ্যায় মাত্র ১১৬ জন। অন্যদিকে, বিসিপিএসের গত পাঁচ বছরের তথ্য হলো, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় ৮ হাজার ১৫২ জন, জেনারেল সার্জারিতে ৬ হাজার ৪৯৩ জন। অথচ অটোল্যারিঙ্গলোজি (মাথা-গলা) ১ হাজার ১১৭ জন পরীক্ষা দিয়েছেন। ওই একই সময়ে অ্যানেসথেসিয়ায় পরীক্ষা দিয়েছেন ৮৮৪ জন।
এ ছাড়া বিসিপিএস এ মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পরীক্ষা দিয়েছেন ১ হাজার ২৫৬১ জন, শিশুতে ৩ হাজার ৯৮১ জন। একই সময়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে পরীক্ষা দিয়েছেন ২৬ জন, রক্তরোগ বিষয়ে ১৮২ জন, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশনে ২৪৩ জন।
বিএসএমএমইউয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় কোন রোগে বেশি মানুষ ভুগছেন, ভবিষ্যতে কোন রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে এবং সেই অনুপাতে চিকিৎসক কত আছেন, কত প্রয়োজন, তার একটি ডেটা ব্যাংক থাকে। এমবিবিএসের পর চিকিৎসকেরা স্নাতকোত্তর কোর্সে ঢুকতে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় যাঁরা খুব ভালো করেন, শুধু তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যেকোনো বিষয়ে পড়তে পারেন। দেশের প্রয়োজন অনুসারে অন্যরা বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন।
বাংলাদেশ ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৭০০ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু যে হারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সে হারে বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে না। ক্যানসারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রতিবছর সর্বোচ্চ ২০ জন বিশেষজ্ঞ বের হচ্ছেন। ক্যানসার সার্জনের সংখ্যা সাকল্যে ২০। চিকিৎসক–সংকট থাকায় রোগের চিকিৎসাও খুবই ব্যয়বহুল।
মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা ২০০। দেশের সব কটি মেডিকেল কলেজে ও মানসিক রোগের চিকিৎসক নেই। প্রতি ২০ লাখ মানুষের জন্য আছেন একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ, প্রতি ৪৫ লাখের জন্য আছেন একজন ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
ফরেনসিক মেডিসিন এবং অ্যানাটমি, ফিজিওলোজি, ফার্মাকোরজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রিতে শিক্ষক–সংকট আছে। মেডিকেল কলেজ চালুর পূর্ব শর্ত হলো, ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য মৌলিক বিজ্ঞানে ১১ জন, ১০০ জনে ১৫ জন, ১৫০ জনে ১৯ জন ও ২০০ জনে ২৪ জন শিক্ষক থাকতে হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) বলছে, পুরোনো তিন থেকে চারটি মেডিকেল কলেজ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কোনো মেডিকেল কলেজেই ​এই পরিমাণ শিক্ষক নেই।
২০০৮ সালে অধ্যাপক মবিন খানকে আহ্বায়ক করে সরকার দেশের স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষার সার্বিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করে। ওই কমিটির প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট। এর মধ্যে আবার তিন–চারটি বাদে বাকিগুলোয় সংকট চরম। যেমন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দেশে প্রতি ২ হাজার ৮০০ জনের জন্য একজন ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ থাকার কথা। বাংলাদেশে ২ লাখ ৮০ হাজার জনের জন্য আছেন একজন। একইভাবে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন অবেদনবিদ থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি দেড় লাখ মানুষের জন্য আছেন একজন।
ফোঁড়া–কাটা থেকে শুরু করে হৃদ্‌যন্ত্র, মস্তিষ্ক বা টিউমারের জটিল অস্ত্রোপচার পর্যন্ত বড়-ছোট সব অস্ত্রোপচারেই শল্যচিকিৎসকের পাশাপাশি অবেদনবিদকে থাকতে হয়। কিন্তু অবেদনবিদের কাজটি লাভজনক নয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জেনারেল সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জটিল অস্ত্রোপচারে যেমন নিউরোসার্জারির ক্ষেত্রে একজন শল্যচিকিৎসক নিজের চেম্বার বা বেসরকারি ক্লিনিকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন; কিন্তু অবেদনবিদ পান সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। আয়ের ভারসাম্যহীনতার কারণে মেধাবীরা অনেক সময় অ্যানেসথেসিয়ায় ক্যারিয়ার করতে চান না।
সরকার ২০০৮ সালে রোগের গতিপ্রকৃতি অনুপাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জোগান কত হওয়া উচিত এবং কত আছে, ঘাটতি মেটাতে করণীয় কী, উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শর্তগুলো কী হওয়া উচিত, তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের আর কোনো তোড়জোড় দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মনজুর-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছি।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইকবাল আর্সলান প্রথম আলোকে বলেন, মৌলিক বিজ্ঞানে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁদের ব্যক্তিগত রোগী দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ বিষয়ের শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশেও এ ব্যবস্থা চালুর জন্য বিএমএ সরকারকে সুপারিশ করেছে।