সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে প্রায়ই চুরি-ডাকাতি হয়। চোর-ডাকাতদের মোকাবিলায় গ্রামের বাসিন্দারা চুনপানি ব্যবহার করে। শুকনা চুনের গুঁড়ার সঙ্গে তাৎক্ষণিক পানি মিশিয়ে চোখে-মুখে ছুড়ে মারলেই কাবু। উপজেলার প্রত্যন্ত মধ্যম রাজনগর গ্রামের বাসিন্দারা গত শুক্রবার এ হাতিয়ার ব্যবহার করেই ডাকাতদলের এক সদস্যকে আটক করে।
মধ্যম রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা মাসুক মিয়া বলেন, গত শুক্রবার ভোরে গ্রামের জিলু মিয়ার (৬০) বাড়িতে ডাকত পড়ে। ডাকাতের দল তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ডাকাত পড়ার খবর পেয়ে মধ্যম রাজনগর, পাশের দক্ষিণ রাজনগর ও মোস্তফানগর গ্রামের শত শত মানুষ জেগে উঠে ওই বাড়ি ঘেরাও করে। পালানোর সময় চোখেমুখে চুনপানি দিয়ে ধরা হয় ডাকাত সোনাই মিয়া ওরফে সোনাই সরদারকে (৪০)। চোর-ডাকাত ধরতে এটি গ্রামের মানুষের এক আদি কৌশল। মাসুক বলেন, ‘পুরা গাঁও ঘুইরা দেখউকা, ঘরে ঘরে চুনপানি আছে।’
এক গৃহবধূ বলেন, প্রতি রাতেই কোনো না কোনো ঘরে হাতের কাছে চুনের গুঁড়া ও পানি রাখা হয়।
ভুক্তভোগী ও গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, আট-নয়জনের ডাকাত দলটি গৃহকর্তা জিলুকে বেঁধে রাখে। তিনি একজনকে চিনে ফেলেন, চিৎকার দেন। এ কারণে তাঁর বুকে ও পিঠে ডাকাতেরা ছুরিকাঘাত করে। হইহই করে লোকজন চলে এলে ডাকাতের দল পালায়। এ সময় ধাওয়া দিয়ে চোখেমুখে চুনপানি ছুড়ে সোনাই মিয়াকে ধরা হয়। পরদিন শনিবার সকালে সোনাইকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু তখন খবর আসে যে ছুরিকাহত জিলুর মৃত্যু হয়েছে। এ খবরে গ্রামের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। সোনাইকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটুনি দিতে চায়। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ হয়। এ সময় কৃষক মফিজুর রহমান (৫৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হয় পুলিশসহ আরও প্রায় ২২ জন।
সোনাই মিয়ার বাড়ি গোয়াইনঘাট উপজেলার লাকি গ্রামে। তাঁর বিরুদ্ধে চুরি-ডাকাতির অভিযোগে ২৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট থানায় ২২টি ও কোম্পানীগঞ্জ থানায় চারটি।
দক্ষিণ রাজনগর গ্রামের একজন গৃহস্থ বলেন, সোনাইকে ধরতে দুই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের বিশেষ প্রস্তুতি ছিল। মুখ বরাবর চুনপানি ছিটানোর পরই সোনাই আর পালাতে পারেননি।
গত শনিবার দুপুরের দিকে সোনাইকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দিয়ে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. কামরুজ্জামান বলেন, চুনপানি অনেকটা দাহ্য পদার্থের মতো। শরীরে পড়ামাত্র পুড়ে যায়। বিশেষ করে চোখের জন্য খুবই বিপজ্জনক। চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া বলেন, চুনপানি বিপজ্জনক, কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ আত্মরক্ষার জন্য এই হাতিয়ার ব্যবহার করে। এই কৌশল বহু পুরোনো। বংশপরম্পরায় চলে এসেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নাসরিন জাহান বলেন, গ্রামে ডাকাতি হয়েছে, গৃহস্থকে ছুরি মেরেছে, একজন ডাকাতকে আটক করা হয়েছে। এ খবরেও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগার পেছনে ছিল যাতায়াতের বিড়ম্বনা। পুলিশ কখন এসে নিরাপত্তা দেবে, এ আশায় মানুষ বসে থাকতে পারে না। এ কারণে প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। চুনপানি এমনই এক কৌশল। তবে এটি সহিংস উপায়। বিকল্প কী করণীয়—এ বিষয়ে পুলিশ পথ দেখাতে পারে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলতাফ হোসেন বলেন, গৃহস্থ জিলু মিয়ার ঘর থেকে রক্তমাখা ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের বর্ণনা থেকে পালিয়ে যাওয়া ডাকাত সদস্যদের নাম ও পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান গ্রামবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি গ্রামবাসীর চুনপানি কৌশল সম্পর্কে অবহিত হয়ে সার্বিক নিরাপত্তায় ‘গ্রাম রক্ষা কমিটি’ গঠনের পরামর্শ দেন। গ্রামবাসীকে আইন হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।