দুদক আইন সংশোধনের জের

জালিয়াতি, প্রতারণার মামলা নিচ্ছে না থানা ও আদালত

প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির কোনো মামলা নিচ্ছে না থানা। মহানগর দায়রা আদালতও নিচ্ছেন না এসব মামলা। এতে বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা।
প্রতারণা, ঘুষ, জমি জাল-জালিয়াতি—এ ধরনের অভিযোগ এখন জানাতে হবে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন সংশোধন করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর প্রতারণা, ঘুষ লেনদেন এবং জমি জাল-জালিয়াতিসহ এ ধরনের বিভিন্ন অপরাধ দুদক আইন, ২০০৪-এ তফসিলভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। মূলত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ দুদক আইনে তফসিলভুক্ত করার কারণেই ওই সব অপরাধ দুদকের আওতায় চলে গেছে। এর পরই এসব অভিযোগ ও মামলা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই অচলাবস্থা।
যেসব ধারা দুদক আইনের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো হলো: সরকারি কর্মচারী হয়ে ঘুষ নেওয়া, ঘুষ নিয়ে প্রভাব সৃষ্টি, বেআইনিভাবে নিলাম ডাকা-সংক্রান্ত অপরাধ (দণ্ডবিধির ১৬১ থেকে ১৬৯ পর্যন্ত ধারা), কাউকে বাঁচাতে সরকারি কর্মচারীদের আইন ভঙ্গ বা ভুয়া দলিল প্রণয়ন করা (২১৭ ও ২১৮ ধারা), সরকারি কর্মচারীদের বিশ্বাস ভঙ্গ (৪০৮ ও ৪০৯ ধারা), ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবহেলা, প্রতারণার মাধ্যমে দলিল জাল করা, তা ব্যবহার (৪২০, ৪৬২-এ, ৪৬২-বি, ৪৬৬-৪৬৯, ৪৭১ ও ৪৭৭-এ ধারা)। বর্তমানে ধারাগুলো তফসিলভুক্ত হওয়ায় সব ধারাই জামিন-অযোগ্য করা হয়েছে।
পুলিশ বিভাগের সূত্র জানায়, দেশে থানায় যত মামলা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই জমির দলিল জালিয়াতি, মানব চোরাচালান এবং ভুয়া চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণাসংক্রান্ত। দুদক আইন সংশোধন করায় পুলিশ বা সংস্থাটির অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এসব বিষয়ে তদন্তের ক্ষমতা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। নতুন আইনে এসব কাজ করবে দুদক। কিন্তু দুদকের তদন্ত করার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই। এতে একমাত্র লাভবান হচ্ছে অপরাধীরা।
জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদকের সংশোধিত আইনে যেসব বিষয় তফসিলভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো সিআইডির তফসিলভুক্ত। এতে করে মামলা তদন্তে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বিষয়টি আমরা পুলিশ সদর দপ্তরে জানিয়েছি, তারা আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে।’
কিন্তু দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট থানা এসব মামলা যদি না নেয়, তবে তারা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের তো মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
মো. বদিউজ্জামান আরও বলেন, এসব বিষয় দুদক আইনের তফসিলভুক্ত হয়েছে অল্প কয়েক দিন। এর আগেও তো থানা এসব মামলা নিয়ে তদন্তের জন্য দুদকেই পাঠাত। যেমন ৪০৮, ৪০৯, ৪২০, ৪৬২ ধারার মামলা। তাহলে এখন দুদক আইনের তফসিলের অজুহাতে কেন তারা মামলা গ্রহণ করবে না? দুদক বা পুলিশ দুটোই তো সরকারের অধীনে। উভয় পক্ষ মিলেমিশে কাজ না করলে তো মানুষের হয়রানি বাড়বেই।
একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন জানান, সম্প্রতি স্বর্ণ উদ্ধারের মামলা রেকর্ড করে দুদকে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তা। সুতরাং বলা যায়, মামলা নেওয়া না-নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের ওপর। এর জন্য দুদক আইন বা ফৌজদারি আইন মুখ্য নয়, থানা কর্মকর্তাদের ইচ্ছেটাই প্রধান।
দুদকের এই বক্তব্য বিষয়ে সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, কোন পর্যায়ে এসে মামলা হস্তান্তর করা হবে, তার কোনো নীতিমালা নেই। এটা নির্ভর করবে তদন্তকারী কর্মকর্তার ইচ্ছার ওপর। বিপত্তিটা এখানেই হবে। দেখা যাবে, এতে জটিলতা না কমে বরং তা বেড়ে যাবে বহুগুণে।
মামলা নিচ্ছেন না আদালতও: দুদক আইন অনুযায়ী, এসব মামলার বিচারের এখতিয়ার এখন বিশেষ জজ আদালতের। এর ফলে এ ধরনের মামলায় হাকিম আদালতগুলো জামিন ও হাজিরা গ্রহণ করছেন না। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তী জামিনে থাকা আসামির জামিনের আবেদনও গ্রহণ করছেন না হাকিম আদালত। কারণ, বর্তমান আইনে কোনো আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ও মানবাধিকার আইন সহায়ক কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে ৫০০ টাকা আত্মসাৎ এবং ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ—এ দুই ধরনের অভিযোগের বিষয়েই এখন দুদকের আশ্রয় নিতে হবে। এর ফলে আইনগত জটিলতা বেড়েছে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী নজিবুল্লাহ বলেন, সংশোধিত আইনের ফলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাগুলো দায়রা জজ আদালতে চলে যাবে। ফলে দায়রা আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়বে। এ কারণে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া দায়রা জজ আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়ে যাবে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে গতকাল বুধবার রাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবগত। এ ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’