জীবনে সফল হওয়ার জন্য আপনি প্রস্তুত তো?

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। ‘গ্রান্টেড’ বলে জীবনে আসলে কিছু নেই। একজন মানুষকে তার জীবনের প্রতিটি ধাপের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। একটি শিশু এটা-সেটা নতুন জিনিস শিখতে শিখতে প্রস্তুত হয় ভবিষ্যতের জন্য। তাই যে শিশুর বাবা-মা যত আগ বাড়িয়ে তার সব কাজ করে দেয় বা আদরের চাদরে তাকে ঢেকে রাখে সে শিশু তত দেরিতে নিজে নিজে পথ চলতে শেখে। আর যে শিশু ছোটকাল থেকেই নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে শেখে সে মেরুদণ্ড সোজা করে বড় হয়।

ঠিক একইভাবে ব্যক্তিজীবন বিবাহিত জীবন বা কর্মক্ষেত্র—সবকিছুর জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক খোলা প্রকৃতিতে বড় হওয়া একটা চারা গাছের মতো। প্রকৃতির আলোছায়ায়, কোনো আলাদা যত্ন ছাড়া একটা গাছ যেমন বড় হয়, ঠিক তেমনি মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক নিজে নিজেই মায়া মমতার বন্ধনে বেড়ে ওঠে। কিন্তু একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য স্বামী এবং স্ত্রীকে নিজেদের প্রস্তুত করতে হয়। আমার কাছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বারান্দার টবে লাগানো চারা গাছের মতো বলে মনে হয়। প্রকৃতিতে বড় হওয়া গাছের মতো সেই চারা গাছ নিজে নিজে বিকশিত হতে পারে না। যত আদর-যত্ন আর পানি পায়, তত দ্রুত সে বড় হয়। ফুলে ফুলে ভরে যায়। ঠিক একইভাবে যে স্বামী-স্ত্রী তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে যত্ন নেয়, সম্পর্কটা যেভাবে থাকলে সুন্দর থাকবে তার জন্য নিজেকে তৈরি করে। যেমন—প্রয়োজন অনুযায়ী ছাড় দেয়, সঙ্গীর খুঁতগুলোকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করে ততই তাদের সম্পর্কের চারাগাছ ডালপালা মেলে। ভালোবাসা পোক্ত হয়।

কর্মক্ষেত্রে ভালো করার জন্য নিজেকে যে তৈরি করতে হয় সেটাতো আমরা সবাই জানি। সে কারণেই বাবা-মায়েরা সন্তানদের ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করানোর নেশায় ছুটে চলেছেন। যেটা আমরা জানি না সেটা হোল কর্মক্ষেত্রে কোনো গুনটি একজনকে অপরজন থেকে আলাদা করে। সেই গুনটি হলো, নতুন কিছু করতে পারার দক্ষতা। চাকরিদাতা মোটেই ক্লাসের প্রথম স্থান অধিকারী ছেলেটিকে খোঁজেন না। তিনি খোঁজেন এমন চৌকস কাউকে যে তার প্রতিষ্ঠানকে নতুন কিছু দিতে পারবে। তাই শুধু পুথিগত বিদ্যা অর্জন কখনোই যথেষ্ট নয়। এর পাশাপাশি আরও নানারকম দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন যা একজন শিক্ষার্থীকে কর্মক্ষেত্রে ভালো করার জন্য তৈরি হতে সহায়তা করে।

কিন্তু এখানেও কিছু ব্যাপার আছে। তৈরি হওয়া মানে কিন্তু শুধু মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার শেখা না। দেশ-বিদেশে একটার পর একটা অ্যাকাডেমিক কোর্স করতে থাকাও না। তৈরি হওয়া মানে হলো এমন একটা অবস্থায় নিজেকে উত্তীর্ণ করা যেন ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কোনো কাজের দায়িত্ব নিতে পারেন। যেন তার ওপর নির্ভর করা যায় যে কোনো সমস্যা বা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। পুরোনো কিছু থেকে তিনি যেন নতুন কিছুর আইডিয়া দিতে পারেন বা উদ্ভাবন করতে পারেন। এগুলো শুধু একমুখী শিক্ষা বা জ্ঞান দিয়ে হয় না। একজন শিক্ষার্থী যে সাইকেল চালিয়ে ক্লাসে যায়, ছুটির দিনে নতুন নতুন জায়গায় ঘোরে, সে চারপাশ থেকে অনেক কিছু শেখে। ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য তার প্রস্তুতি অন্য আট/দশটা ছেলের চেয়ে ভালো হয়। যে মেয়েটি আজ সারা দিন ইউটিউবে ওরিগামি বানানো শেখে আর সবাইকে কাগজ দিয়ে বানানো নানান জিনিস উপহার দেয়, তার এই শিল্পচর্চাই একদিন তাকে কর্মক্ষেত্রে সবার চেয়ে আলাদা করবে। এটাও পরবর্তী সাফল্যময় জীবনের জন্য তার প্রস্তুতির একটা অংশ। সাকিব আল হাসান বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার এ কারণেই শুধু নয় যে তিনি জাত ক্রিকেটার। পৃথিবীতে সবাই কমবেশি মেধা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু সাকিব আল হাসান আজকে এই অবস্থানে এসেছেন কেননা প্রতি মুহূর্ত তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিজেকে আরও দক্ষ, আরও তুখোড় করার জন্য। দেশ-বিদেশে যেখানেই তিনি খেলতে যান সেখানে কোচ বা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে তিনি খেলার বিভিন্ন টেকনিক শেখেন। নিজের দুর্বলতা বা ভুলগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো শুধরানোর চেষ্টা করেন। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে ফিটনেস ঠিক রাখতে তিনি যে পরিমাণ ওজন কমিয়েছেন তা ছিল চোখে পরার মতো। এ কারণেই সাকিব অন্য সবার চেয়ে আলাদা।

ব্যক্তি জীবনে লম্বা পথ হাঁটার জন্য, ভিন্ন স্বাদের খাবার খাওয়ার জন্য বা অপরিচিত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে যে সেই বোঝে ভ্রমণের প্রকৃত আনন্দ। যে তরুণীটি শখের বশে আজ নিত্যনতুন রান্না শিখছেন তিনি হয়তো নিজেও জানেন না অদূর ভবিষ্যতে তিনি একটি অনলাইন খাবার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত হোক আর কর্মজীবন হোক, নিজের প্রয়োজনেই নিজেকে প্রতিনিয়ত তৈরি করতে হবে। তাই সকল ব্যস্ততা থেকে আজ একটু অবসর নিন, আপনি যে কাজটি ভালো পারেন বা যা করতে আপনি ভালোবাসেন সেটাকেই একটু বিশ্লেষণ করুন আর নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- গৎবাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে একটু ঝালাই করে নিতে, নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে জীবনকে একটা নতুন মাত্রা দিতে আপনি প্রস্তুত আছেন তো?

উপমা মাহবুব: উন্নয়ন পেশাজীবী এবং কলামিস্ট