
দেশে মাতৃমৃত্যু কমছে না। সাত বছর আগে করা সরকারের সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু জরিপে দেখা গিয়েছিল, এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৪ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে তা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু-সম্পর্কিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করতে পারেনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নারী স্বাস্থ্য নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংস্থা ও বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস্তবে দেশে মাতৃমৃত্যু কমেনি, বরং বাড়ছে। ২০১০ সালে দেশে ৭ হাজার ৩৩২ মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। গত বছর মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ হাজারের কিছু বেশি।
গর্ভধারণজনিত জটিলতা, প্রসবকালে বা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে কোনো প্রসূতির মৃত্যু হলে তাকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়। তবে এই সময়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে (সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা ইত্যাদি) বিবেচনা করা হয় না। জীবিত জন্ম নেওয়া প্রতি লাখ শিশুর অনুপাতে হিসাবটি করা হয়। একটি দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কত ভালো, তার একটি মৌলিক সূচক মাতৃমৃত্যুর হার। উচ্চ মাতৃমৃত্যু হারের দেশকে উন্নত স্বাস্থ্যের দেশ বলা যায় না।
ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধির দিকটি উঠে এসেছে। সংস্থাটির ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে কম ছিল। সে সময় বাংলাদেশে ছিল ১৭০ আর ভারতে ১৯০। কিন্তু পরের বছরের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে—১৭৬। আর ভারতে কমেছে—১৭৪।
জনস্বাস্থ্য ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রে এই পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা হয়নি। মাতৃমৃত্যু দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। বিপরীতে মাতৃমৃত্যু বৃদ্ধির নতুন ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। মাতৃমৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রসূতি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতপার্থক্যও রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি নথিতেও সব মাতৃমৃত্যুর তথ্য আসছে না। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে মাতৃমৃত্যুর ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জিত হবে না, এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লতিফা শামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু দুঃখজনক। মৃত্যু হার যদি আগের মতোই থাকে, তাহলে তা মেনে নেওয়া যায় না। কর্মসূচিতে কোথায় কী সীমাবদ্ধতা আছে, তা চিহ্নিত করে এখনই দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
মাতৃমৃত্যু পরিস্থিতি
দেশে মাতৃমৃত্যুবিষয়ক সর্বশেষ জরিপ হয়েছিল ২০১০ সালে। ওই জরিপ (বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে বা বিএমএমএস-২০১০) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়। এই হার ছিল আগের দুই দশক ধরে মাতৃমৃত্যু কমে আসার ধারাবাহিকতা। গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদান উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় জার্নি টু এসডিজিস ২০৩০ ফর হেলথ: বাংলাদেশ সেটস মোমেনটাম শিরোনামের একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৫৭৪, ২০০১ সালে ৩২০ এবং ২০১০ সালে ১৯৪। ২০১৫ সালে তা কমে ১৭৬ হয়।
অবশ্য ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৩ সালে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৭০। সে ক্ষেত্র ২০১৫ সালে বেড়ে হয়েছে ১৭৬।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিনে (২০১৬) বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে সরকারের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে (সদর, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মাতৃ ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র) মোট ৪ হাজার ৮৯ জন মায়ের মৃত্যু হয়।
জনস্বাস্থ্য ও প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। সাড়ে ৭ হাজার বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে মাতৃমৃত্যুর সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও তা সরকারি হাসপাতালে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যার কাছাকাছি। এ ছাড়া অনেক মায়ের মৃত্যু হচ্ছে বাড়িতে, যার সঠিক তথ্য সরকারের কোনো দপ্তরে থাকে না। সব মিলিয়ে মোট মৃত্যু ও মৃত্যুর হার দুই-ই বেড়েছে।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘অনেক জায়গায় অদক্ষ সার্জন, প্রশিক্ষণহীন স্বাস্থ্যকর্মী প্রসবসেবা দিচ্ছেন। ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম দিচ্ছেন। অস্ত্রোপচারে প্রসব বহু বেড়েছে, মৃত্যুও বেড়েছে। তাই মাতৃমৃত্যুর হার কিছুটা বাড়তেও পারে।’
সব তথ্য সরকারি নথিতে নেই
মাতৃমৃত্যুর সব তথ্য সরকারের কাছে থাকে না। নারী সংগঠন নারীপক্ষ ২০০৩ সাল থেকে বরিশাল বিভাগে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে কাজ করছে। ২০১১ সালে বিভাগের ৫টি জেলার ১৪টি উপজেলার ১১১টি ইউনিয়নের মাতৃমৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করে নারীপক্ষ। সংগঠনের সহপ্রকল্প সমন্বয়কারী সামিয়া আফরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১১১টি ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়ির তথ্য আমরা সংগ্রহ করি। প্রতিটি মাতৃমৃত্যুর তথ্য লিপিবদ্ধ করি। তারপর সরকারের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। আমরা দেখতে পাই, সব মাতৃমৃত্যুর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা লিপিবদ্ধ করেন না বা করতে পারেন না। সরকার যা বলে, মৃত্যুর সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।’
ওই সময়ে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা সদর হাসপাতালে ও ইউনিয়ন পরিষদে ১০২টি মাতৃমৃত্যুর তথ্য সরকারিভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু নারীপক্ষ ও তাদের ১৬টি সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা ১১১টি মৃত্যুর ঘটনার সন্ধান পেয়েছিলেন। ৯টি ঘটনার (২টি ক্লিনিক, ২টি হাসপাতালে নেওয়ার পথে, ৫টি বাড়িতে মৃত্যু) তথ্য সরকারের নথিতে ছিল না। অর্থাৎ ৮ শতাংশ মৃত্যুর তথ্য ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল বিভাগের একটি জেলার সিভিল সার্জন গত সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোকে বলেন, সব মৃত্যুর তথ্য সরকারের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। চর এলাকার এবং প্রসবপূর্ব স্বাস্থ্যসেবা নেননি, এমন মায়ের তথ্য বাদ পড়ে।
কেন মৃত্যু কমছে না
২০১০ সালের জরিপ প্রতিবেদনে মাতৃমৃত্যুর সাতটি দিক উল্লেখ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ৩১ শতাংশ, খিঁচুনি ২০ শতাংশ, প্রসব জটিলতা বা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসব ৭ শতাংশ, গর্ভপাত ১ শতাংশ, পরোক্ষ কারণ (হৃদ্রোগ, জন্ডিস ইত্যাদি) ৩৫ শতাংশ, সরাসরি অন্যান্য কারণ ৫ শতাংশ এবং অজানা কারণ ১ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রাথমিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি) কাজী জাহাঙ্গীর আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, পরোক্ষ কারণে এখন বেশি মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। সেটা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। জন্ডিস বা হৃদ্রোগের কারণে মাতৃমৃত্যু কমানোর কৌশল বের করা কঠিন হয়ে পেড়েছে।
বছরে ৩২ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। এর তিন-চতুর্থাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে।
এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারে প্রসব বৃদ্ধির সঙ্গে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য) মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অদক্ষ চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করছেন। অস্ত্রোপচারকালে এবং পরে সংক্রমণ-জটিলতায় মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
এসডিজিও অর্জিত হবে না
এমডিজির মাতৃস্বাস্থ্য-বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অনেকে আশঙ্কা করছেন, বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এমডিজির ৫ নম্বর লক্ষ্যে ছিল মাতৃস্বাস্থ্য। তাতে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ১৪৩-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৭৬।
এসডিজিতে ২০৩০ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে এই হার ১৯৪ বা তার কাছাকাছি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ১২ বছরে মাতৃমৃত্যুর হার ৬৪ শতাংশ কমাতে হবে। ১৯৯০-২০১৫—এই ২৫ বছরে মাতৃমৃত্যু যে হারে (৭০ শতাংশ) কমানো হয়েছিল, আগামী ১২ বছরে তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে কমাতে হবে।