Thank you for trying Sticky AMP!!

নিয়মকানুনের তোয়াক্কা নেই

>

• বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
• বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে আইনের শর্ত ভঙ্গ করছে
• মাত্র তিনটি সব শর্ত পূরণ করার সনদ পেয়েছে
• মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৪টি
• স্থায়ী সনদের যোগ্যতা অর্জনের সময় পেরিয়েছে ৫৪
• শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদ পেয়েছে ৩
• নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেছে ২০

বিশ্ববিদ্যালয়টি চলছে একটি ভাড়াবাড়িতে। নিয়মিত শিক্ষার্থী আছেন ১২০ জন। আর কয়েক শ আছেন শুক্রবারের শিক্ষার্থী, যাঁরা মূলত চাকরিতে উন্নতির আশায় ডিগ্রি নিতে এসেছেন। উপাচার্য আর কোষাধ্যক্ষ অতিথি পাখি। প্রথমজন ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার যান, রোববার ফেরেন। দ্বিতীয়জন যান মাঝেমধ্যে।

অধ্যাপক পদধারী মাত্র তিনজন। ১১টি বিভাগ চালু আছে। তার মধ্যে মিডিয়া ও সাংবাদিকতা বিভাগে ছাত্র মাত্র একজন। অর্থনীতিতে ছাত্রই নেই। রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি নামের এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নাটোর শহরে।

দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা চলছে ঢাকার উত্তরায় ভাড়াবাড়িতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এখনো এটিকে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পুরোদমে কাজ চালাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেল, দরদাম করেও ভর্তির সুযোগ আছে।

শুধু এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, কম-বেশি নিয়মকানুনের বরখেলাপ করছে ধরতে গেলে ৮০ ভাগ চালু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অনিয়মের কারণে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৪টি। এই মুহূর্তে মোট ৯৫টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে ৩ লাখ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ অনেক। কিন্তু ইউজিসি ও শিক্ষাবিদদের মূল্যায়নে বড়জোর ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে বা মোটামুটিভাবে চলছে। বাকিগুলো কোনো না কোনোভাবে আইনের শর্ত ভঙ্গ করছে। সব কটি শর্ত পূরণ করার প্রক্রিয়া শেষ করেছে মাত্র ৩টি।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ১০ এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেন, কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুবই ভালো করছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো পড়াশোনার মান একেবারেই খারাপ। কখনো সনদ বিক্রির অভিযোগও ওঠে। আরও নিবিড় তদারক করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আইন মানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

অনুমোদন ও পরিচালনার জন্য আইন প্রথম হয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনার বছর ১৯৯২ সালে। সেটা বাতিল করে ২০১০ সালে নতুন আইন এসেছে। আইন বলছে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমোদন নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারে। সে জন্য কমপক্ষে নয়জন ট্রাস্টি তথা মালিকদের নিয়ে পর্ষদ, ২৫ হাজার বর্গফুটের নিজস্ব বা ভাড়া বাড়ি, ৩টি অনুষদ ও ৬টি বিভাগ এবং সংরক্ষিত তহবিল হিসেবে এলাকাভেদে দেড় থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা থাকতে হবে।

এগুলোসহ মোট ১০টি শর্ত পূরণ করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাময়িক অনুমোদন দেবে। পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে আরও কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ পাওয়ার যোগ্য হবে। এ ক্ষেত্রে শর্তগুলোর মধ্যে আছে, এলাকাভেদে নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়া, ৩ শতাংশ আসন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা এবং গবেষণার জন্য বাজেট রাখা।

আওয়ামী লীগের টানা তিন আমলে সাময়িক অনুমোদন পেয়েছে মোট ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলো এখনো ৭ বছরের চৌকাঠ পেরোয়নি। বয়সের এ চৌকাঠ পেরিয়েছে ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেগুলোর মাত্র তিনটি স্থায়ী সনদ অর্জন করতে পেরেছে। আরও কয়েকটির আবেদন প্রক্রিয়াধীন।

সাধারণভাবে আইনে উপাচার্যসহ শীর্ষ পদে নিয়োগ, স্থায়ী ও খণ্ডকালীন শিক্ষকের অনুপাত, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভা, শিক্ষার্থী ফি এবং সরকারকে বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়াসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধান আছে। এ ছাড়া শাখা ক্যাম্পাস খোলা যাবে না।

ইউজিসির চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মনে করেন, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি নিয়মগুলো মানছে না। এমনকি কেউ কেউ না পড়িয়ে স্রেফ সনদ বিক্রি করে।
চার ভাগে বিভক্ত হয়ে সারা দেশে শাখা খুলে সনদ বিক্রি করত বলে তদন্তে প্রমাণিত হলে সরকার দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৬ সালে বন্ধ করে দেয় । গত ২৭ বছরে আরও মাত্র ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে সেগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে টেকেনি।

আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে আরও বলেন, ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শই শুধু দিতে পারে। তা ছাড়া ব্যবস্থা নিতে গেলে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় মামলা করে। তখন বছরের পর বছর চলে যায়। তাঁর মতে, কার্যকর তদারকির জন্য ইউজিসির আইন সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করতে হবে।

ট্র্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৪ সালের গবেষণা প্রতিবেদনটিও বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার অনুপাতে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির জন্য বরাদ্দ ও জনবল বাড়েনি। সরকারের কোনো সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।

মালিকদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেনের মতে, আইনটি সংশোধন করা দরকার। এর সব কটি বিধান বাস্তবসম্মত নয়।

শুক্রবারের বিশ্ববিদ্যালয়
নাটোর শহরের বড় হরিশপুরে রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি (আরএসটিইউ)। গত ২১ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে দেখা গেল, ভাড়া বাড়িটির একটি ঘরে তিনজনকে পড়াচ্ছেন একজন শিক্ষক। আরেকটিতে দুজন এবং অপর আরেকটিতে চারজন ছাত্রছাত্রী।

নাইমুল রশীদ ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে বিবিএর শেষ পর্বের ছাত্র। তিনি বলেন, ক্লাসে তাঁরা মোট শিক্ষার্থী ছয়জন। উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ কেউই ক্যাম্পাসে ছিলেন না। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বললেন, তাঁদের স্থায়ী শিক্ষক ৩২ জন। খণ্ডকালীন আছেন ১০-১২ জন। তিনজন অধ্যাপক আছেন। তাঁরা বিশেষ আসেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৭৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদের মধ্যে ছয় শতাধিক অনিয়মিত। তাঁরা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস চাকরিজীবী বা চাকরিসন্ধানী। ছুটির দিন শুক্রবার তাঁরা ক্লাস করেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি কিছুটা প্রাণ পায়। উপাচার্যও তখনই ঢাকা থেকে আসেন। সহ-উপাচার্য নেই।

পরদিন শুক্রবার গিয়ে উপাচার্য মো. শাহজাহানকে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, নিয়মিত শিক্ষার্থী বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। ভর্তিতে নানা ধরনের ছাড় দিচ্ছেন।

অনুমোদনের আগেই ভর্তি
অনিয়মের দায়ে ২০০৬ সালে দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা বন্ধ করা হয়েছিল। পরে আদালতের আদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আবার চালু করতে দেয়। আইনানুযায়ী পাঠদানের পরিস্থিতি দেখার জন্য ইউজিসি একটি কমিটি করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলা চলছে। শিক্ষা কার্যক্রম চালুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো ইউজিসির অনুমোদন পায়নি। অথচ ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সূত্রমতে বিশ্ববিদ্যালয়টি গত নভেম্বরে একটি জাতীয় দৈনিকে শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ইউজিসির কমিটি উত্তরায় ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির আলামত পায়।

কমিটি আরও দেখে, আইনের বরখেলাপ করে অনুমোদন না নিয়ে দুটি ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইউজিসি গত বছরের ডিসেম্বরে এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। তবে গত ১৯ মার্চ পর্যন্ত এর উত্তর আসেনি।

গত ৩১ মার্চ এই প্রতিবেদক রাজধানীর উত্তরায় পলওয়েল করোনেশন ভবনে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তাঁকে একজন কর্মকর্তা ভর্তি হতে কত টাকা লাগবে, তা জানাতে থাকেন। তারপর নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পরিচয় দিয়ে এক নারী আসেন। তিনি বলেন, ভর্তি ফিতে ‘ডিসকাউন্ট’ দেওয়া যাবে।

নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি ৩৪টি
সাত বছরের বেশি বয়সী ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৪টি এখনো নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার শর্ত পুরোপুরি পূরণ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার ছয়বার সময় দিয়েছিল।
নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ একর এবং অন্যান্য এলাকায় ২ একর পরিমাণ জমি থাকতে
হবে। এই ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৬টি নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নির্মাণাধীন ক্যাম্পাসে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর দুটি ক্যাম্পাসে গেছে, তবে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম জমিতে।

ইউজিসির তালিকা অনুযায়ী, ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকঠাক নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেছে। তবে এগুলোর দুটি আবার ঢাকায় আলাদা ক্যাম্পাস রেখেছে, আইনে যার সুযোগ নেই। আইন মেনে ক্যাম্পাসে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত তিনটি—ঢাকার আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটি। আরও আছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল, সময় পেয়েও যারা নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি, তাদের ছাত্র ভর্তি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি।

সভা ও অন্যান্য
বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বছরে একবারও সিন্ডিকেট বা একাডেমিক কাউন্সিলের সভা করে না।
ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একবারও সিন্ডিকেট সভা হয়নি। এগুলোর মধ্যে বড় উদ্যোক্তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা করেনি আটটি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া চারটি বিশ্ববিদ্যালয় সে বছর একবারও ট্রাস্টি পর্ষদের সভা করেনি।অন্যদিকে দ্বন্দ্ব-মামলার সমস্যাও আছে। একদিকে আছে সরকার বা ইউজিসির সঙ্গে আইনি প্রশ্নে মামলা, অন্যদিকে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব-মামলা চলছে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু বিচ্যুতি সরাসরি শিক্ষার মান ও অলাভজনক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছেমতো ফি বসাচ্ছে। শীর্ষ তিন পদ উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে আছে ঢিলেমি। অধিকাংশই নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয় না।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। তিনি বলছেন, বড়জোর ১৫টি সব নিয়মকানুন মেনে চলে। কড়া নজরদারি হলে এমনিতেই কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে।