Thank you for trying Sticky AMP!!

নৌকাতেই ঘরবাড়ি, নৌকাতেই বসতি

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার টুকদিরাই গ্রামে শতাধিক বেদেনৌকায় বাস করেন। ছবি: লেখক

যাযাবর জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন অন্যতম। এই সম্প্রদায়ের সিংহভাগ নারী-পুরুষই যাযাবর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার টুকদিরাই গ্রামে শতাধিক বেদে সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে। গ্রামে রয়েছে বেদে হাটি (স্থানীয়দের কাছে বাইদ্যা হাটি নামে পরিচিত) নামে একটি পাড়াও। তাদের একটা অংশ ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আরেকটা অংশ গ্রামের পাশে নদীতে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে। টুকদিরাই নিজের গ্রাম হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তাদের এভাবে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করতে দেখে আসছি। ঈদে বাড়িতে গিয়ে আরেকবার তাঁদের জীবনযাপন দেখতে চলে গিয়েছিলাম বেদেনৌকা বহরে।

উপার্জনের ক্ষেত্রে বেদেরা নারীনির্ভরশীল এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশায় যুক্ত থাকার ব্যাপারটা এখানে ভিন্ন। নারী-পুরুষ মিলেই উপার্জন করে সংসার চালান। আর এই পাড়ার বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন ঝাড়ফুঁক, শিঙা লাগানো, তাবিজ-কবচ বিক্রি করা, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানোর মতো সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশায় এখন আর খুব একটা যুক্ত নয়। কালের প্রভাবে এসবে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে, তারা নিজেদের পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য কিছুসংখ্যক বেদে এখনো সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশায় যুক্ত।

বেদেদের কেউ কেউ গ্রামে গ্রামে নারীদের-শিশুদের ব্যবহার্য জিনিস আর ঘরের তৈজসপত্র বিক্রি করে বেড়ান। তবে বেশির ভাগই অন্যান্য পেশায় যুক্ত হয়েও জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। নানা পেশায় যুক্ত থাকা নারী ও পুরুষ প্রতিদিন সকালবেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আর দিন শেষে ঘরে ফিরে আসেন। আবার অনেকে বর্ষায় নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে পুনরায় ফিরে আসেন। তাঁদের জীবনযাপনের কিছু ব্যাপার যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি কিছু ব্যাপার কষ্টেরও। অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করেন। যেন আধুনিকতার এতটুকু ছোঁয়া লাগেনি মানুষগুলোর মধ্যে। তথ্যপ্রযুক্তির ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁরা যেন অনেকটাই অপরিচিত। শত প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন পার করছেন একেকজন। শত প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠছে বেদে সম্প্রদায়ের একেকটি শিশু।

সারা বছর নৌকায় থাকেন বেদেরা। ছবি: লেখক

এক বেদে শিশুর সঙ্গে কথা হয় ছবি তুলতে গিয়ে। শিশুটির নাম সাকিবা। ছবি তোলার সময় সাকিবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সে খেলাধুলা কোথায় করে। সাকিবা জানায়, সে নৌকাতেই খেলাধুলা করে, নৌকাতেই সময় কাটায়। খেলাধুলার একমাত্র সঙ্গী পাশের নৌকার আরেকটি শিশু। অন্য ১০টা শিশুর জীবনযাপন থেকে সাকিবার জীবনযাপন, বেড়ে ওঠার গল্প যেন ভিন্ন। সে বড় হচ্ছে ভিন্নভাবে, ভিন্ন পরিবেশে। যেখানে এই বয়সে তার দুরন্তপনায় মেতে থাকার কথা, সেখানে সে বড় হচ্ছে অনেকটা বন্দী পরিবেশে।

বেদেরা এখন নিজেদের পেশা বদল করছেন হরহামেশাই। ছবি: লেখক

সাকিবার সঙ্গে মজার ছলে কথা বলার সময় তার মা ছোট নৌকার এক পাশে রান্না করছিলেন। জানতে চাইলাম, এই ছোট নৌকায় বসবাস করতে অসুবিধা হয় না? তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘অসুবিধা আর কিতা অইত রে পুত? আমরার এই নৌকাতই রান্দত থাকি শুরু করি ঘুমানি, সব করা লাগে। অসুবিধা অইলেও এভাবেই থাকা লাগব। কুনতা করার নাই। আল্লায় যেলা রাখছইন, অলাই থাকা লাগব।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলছিলাম। নৌকা এত সাজানো-গোছানো আর পরিপাটি ছিল যে নৌকা থেকে নামতেই ইচ্ছে করছিল না। তিনিই জানালেন, তিনি পরিপাটি থাকতে পছন্দ করেন। তাই নৌকা এভাবে পরিপাটি করে রেখেছেন।

শিশু সাকিবা সারা দিন কাটে নৌকায়। ছবি: লেখক

আর্থিক অবস্থা ততটা ভালো নয় তাঁদের। নৌকার বহরের অনেকেই দিন আনেন দিন খান। এভাবেই জীবন যাপন করে আসছেন। সারা দিন কাজ শেষে ফেরার পথে নিজের উপার্জিত টাকায় বাজার-সদাই করে আনেন। অন্য ১০টা শিশুর জীবনযাপন থেকে সাকিবার জীবনযাপন যেমন ভিন্ন, তেমনি অন্য ১০ জন সাধারণ মানুষের চেয়ে সাকিবার মা-বাবার জীবনযাপনও যেন ভিন্ন। নৌকাতে জীবন যাপন করাটা একপলকে দেখলে হয়তো আমাদের অনেকের কাছে সাময়িকভাবে সুখের মনে হবে। উপভোগের মনে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। শুধু শিশু সাকিবার কথা ভাবলেই তা খুব ভালোভাবে অনুভব-উপলব্ধি করা যায়। নৌকাতেই ঘরবাড়ি, নৌকাতেই বসতি স্থাপন করে আজীবন বসবাস করাটা কারও কাছেই সুখময় হওয়ার কথা নয়। তাঁরাও হয়তো নিজেদের এই অবহেলিত জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান, জীবনমানের উন্নতি চান।

*লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, গণিত বিভাগ এমসি কলেজ, সিলেট