
সীমানা পাড়ার পাহাড়গুলোর বুকজুড়ে জুমের খেত। সেসব খেত এখন ফসলে ভরা। ধানগুলো পেকে গেছে। সবুজ পাহাড়ে যেন হলদে আভা ছড়িয়েছে। জুমে তো শুধু ধানই হয় না। ধানের পাশে তিল, মরিচ, চিনালসহ (পাহাড়ি ফল) নানা ফসল। আর আছে মারফা।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দুর্গম সীমানা পাড়ায় পৌঁছাতে বেলা প্রায় পড়ে এল। পাহাড়ি পথে দেখা হলো পঁলেরক্ষী ত্রিপুরা, অনিল মোহন ত্রিপুরা, নীল রতন ত্রিপুরা ও নিত্যানন্দ ত্রিপুরাদের সঙ্গে। পাহাড়ের এ গ্রামটি ত্রিপুরা অধ্যুষিত এবং গ্রামবাসীদের সবাই জুমিয়া (জুম চাষি)। জুম থেকে মারফা সংগ্রহ করে গ্রামে ফিরছিল গ্রামের মানুষেরা।
পাহাড়ের শসাজাতীয় একটি সবজি মারফা। জুমের ধানের চারার ফাঁকে ফাঁকে মারফার বীজ বপন করা হয়। পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়িদের কাছে মারফা (শসা) বিভিন্ন নামে পরিচিত। মারফাকে ত্রিপুরা সম্প্রদায় দরমাই, চাকমা সম্প্রদায় মামবারা, মারমা সম্প্রদায় ঞোপ্রুসি বলে পরিচিত। অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছেও ভিন্ন ভিন্ন নামে এর পরিচিতি রয়েছে। তবে জুমে মারফার চাষপদ্ধতি একই। বাঙালিদের কেউ কেউ মারফা ও শসা বলেই চেনে।
অনিল মোহন ত্রিপুরা বললেন, এপ্রিল মাসে পাহাড় জুমচাষের জন্য উপযুক্ত করে মে ও জুন মাসে ধানসহ বিভিন্ন সবজির বীজ বপন করা হয়। ধানের চারার ফাঁকে ফাঁকে মারফার বীজ বপন করেন। আগস্ট মাসে প্রথম সপ্তাহ থেকে তাঁরা মারফা সংগ্রহ করতে পারেন।
বাজারে বিক্রির জন্য সপ্তাহের বুধবার ও শুক্রবার জুমে গিয়ে মারফা সংগ্রহ করেন তাঁরা।
জুমচাষিরা এবার মারফার ফল নিয়ে খুশি। নিত্যানন্দ ত্রিপুরা বললেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর মারফার উৎপাদন ও দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর প্রতি কেজি মারফা ছিল ১২ থেকে ১৩ টাকা। এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৭ টাকা।
মারফা কচি অবস্থায় সবুজ, আধা পাকা অবস্থায় সাদা ও পাকলে হলদে রং ধারণ করে। এক একটি লতায় ১০ থেকে ১৫টি পর্যন্ত মারফা ফলে। একেকটি মারফার আকার ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির বেশি ওজন হয়।
পাহাড়ের বসবাসরত সব জনগোষ্ঠীর কাছে মারফা একটি জনপ্রিয় সবজি। স্থানীয় বাজারে জুমের প্রতি কেজি মারফা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।
দীঘিনালা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুপন চাকমা বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গত বছর ৩৮ হেক্টর পরিমাণ জমিতে মারফা (শসা) চাষ হয়েছি। উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। এ বছর ৪০ হেক্টর পরিমাণ জমিতে মারফা (শসা) চাষ করা হয়েছে। এ বছর মারফার উৎপাদন গত বছরের চেয়ে বেশি। উৎপাদনের পূর্ণাঙ্গ হিসাব অক্টোবরের শেষে পাওয়া যাবে।
রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের পরামর্শক পলাশ বলেন, ‘মারফায় (শসা) প্রচুর স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে। শসায় ৯৫ ভাগ পানি আছে। ফলে শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। শসা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। শসার রস ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও বেশ উপকারী। এ ছাড়া কিডনি, ইউরিনারি, ব্লাডার, লিভারসহ শরীরের বিভিন্ন সমস্যার জন্য শসা উপকারী।
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রশিদ আহমেদ বলেন, ‘সমতল জমিতে শসা চাষ করতে হলে সেচসুবিধা দিতে হয়। জুমের মারফায় তা দিতে হয় না। আমরা জুমের মারফার অধিক ফলন, উন্নত জাত তৈরি, খরাসহিষ্ণু ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে উৎপাদনশীল করার জন্য কাজ করছি।’