বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠি
রাজনীতিতে সমর্পিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বড় সময় কেটেছে জেলখানায়। সেখানে থাকতে তিনি যেমন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, নেতা-কর্মী ও স্বজনদের কাছ থেকে বহু চিঠি পেয়েছেন, তেমনি তিনিও তাঁদের লিখেছেন। কারাগারের বাইরে থাকতে রাজনীতির সুবাদেই তিনি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, অনেকে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে তাঁর পত্র যোগাযোগ হতো। কারাগারে থাকতে বেশির ভাগ চিঠি পেতেন দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে।
সরকারের গোয়েন্দাদের বাজেয়াপ্ত করা কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর লেখা এবং তাঁকে লেখা চিঠির হদিস সম্প্রতি পাওয়া গেছে সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বইয়ে।
কারাগারে বসেও বঙ্গবন্ধু দেশের কথা ভাবতেন। কারাগারের ভেতরে বা বাইরের যেসব ঘটনা তাঁকে আলোড়িত করত, সে সম্পর্কে তিনি অকপটে তাঁর মতামত প্রকাশ করতেন। বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতা-কর্মী ও স্বজনের বাইরে বিদেশি রাষ্ট্রনেতা ও দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদেরও চিঠি লিখেছেন। তাঁর লেখা থেকে বাছাই করা কিছু চিঠি এখানে পত্রস্থ হলো।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতির অভিযোগ এনে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে জেলে পোরেন। এই প্রেক্ষাপটে বাবা শেখ লুৎফর রহমানকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠিটিতে বেদনা ও ক্ষোভ ছিল। আজীবন নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি করেছেন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মানতে পারেননি। পরে বঙ্গবন্ধু আইনি লড়াই করেই অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। চিঠিটি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
জ্যেষ্ঠ কন্যা ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠিটি জেলখানার বাইরে থেকে। শেখ হাসিনা তখন স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াসহ সুইডেন সফরে। ছোট্ট এই চিঠিতে ব্যক্তিগত কুশলাদির পাশাপাশি দেশের দুই কৃতী সন্তান তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের মৃত্যুর খবর দেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে লিখেছিলেন ব্যক্তিগত কুশল জানতে চেয়ে। চিঠিটি রাজনৈতিক ছিল না।
তবু পািকস্তান সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে অলি আহাদ ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু তাঁকে লিখেছিলেন করাচি থেকে। তখন গণপরিষদের অধিবেশন চলছিল।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ দুই কিস্তিতে প্রকাশিত লেখক আবুল ফজলের প্রবন্ধ ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ প্রকাশের পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে দুটি চিঠি লেখেন। প্রথমটি লেখেন ১৯৬৯ সালের ১৭ নভেম্বরে। আবুল ফজল পরে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি। তবে ১৯৬৯-এর শেষের দিকে তাঁর কাছ থেকে আমি নিজের হাতে লেখা দু’খানা চিঠি পেয়েছিলাম। তখন তিনি বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সর্বপ্রধান রাজনৈতিক তথা বিরোধী দলের নেতা।’
চিঠি-১: বাবা লুৎফর রহমানকে
ঢাকা জেল
১২.১১.৫৮
আব্বা
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লা আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবো না।
যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোনো কাজই করা উচিত না। এ দেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।
আপনার স্নেহের
মুজিব
গোপালগঞ্জের বাসাটা ভাড়া দিয়া দেবেন। বাসার আর দরকার হবে না।—মুজিব।
সূত্র: পূর্ব পাকিস্তান সরকার, হোম পোল, এফ/এন, ৬০৬-৪৮ পিএফ, খণ্ড ৯
চিঠি-২: জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে
১৩.৬.৬৯
হাছু মনি
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। ওয়াজেদের চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তরও দিয়েছি বোধ হয় পেয়ে থাকবে। জেল হতে বের হয়ে তোমাকে ভাল করে দেখতেও পারি নাই। শুধু তোমার শরীরের দিকে চেয়ে তোমাকে যেতে দিয়েছি। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ওয়াজেদের শরীর কেমন। আমরা সকলেই ভাল আছি। চিন্তা করে শরীর নষ্ট করিও না। বোধ হয় শুনেছ মানিক ভাই পিন্ডিতে হঠাৎ মারা গিয়েছেন। বুঝতেই পার আমার অবস্থা। প্রফেসর হাই সাহেবও মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন কৃতী সন্তান আমরা হারালাম। চিন্তা করিও না। সুইডেন খুব সুন্দর দেশ। তোমাদের খুব ভাল লাগবে। চিঠি দিও।
তোমার
আব্বা
সূত্র: জাতির জনক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ.২১১
চিঠি-৩: তাজউদ্দীন আহমদকে
ঢাকা জেল
১৯ /৮ / ৬৬ (সিল)
স্নেহের তাজুদ্দিন
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। কেমন আছ? খবর জানি না। আমাকে খবর দিও। চিন্তা করিও না। সকলকে ছালাম দিও। শরীরটা বেশী ভাল না তবে কেটে যাচ্ছে। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি—
তোমার মুজিব ভাই
সূত্র: পূর্ব পাকিস্তান সরকার, হোম পোল, এফ/এন, ৬০৬-৪৮ পিএফ, খণ্ড ২৬
চিঠি-৪: অলি আহাদকে
সমারসেট হাউস
করাচি
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬
প্রিয় অলি আহাদ,
তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আশা করি, গণপরিষদ হতে আমাদের ওয়াক আউট-এর পর ২ মার্চ ঢাকায় ফিরব। তোমার অসুবিধা সম্পর্কে আমি পুরোপুরি জানি ও অনুভব করি। আমাদের সংগঠনের কিছু টাকা সংগ্রহ করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি।
৩ ও ৪ মার্চের প্রস্তাবিত সভা তুমি বাতিল করেছ জেনে আমি খুশি হয়েছি। কারণ তুমি জানো যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া এমন একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। অবশ্যই একটি কাউন্সিল সভা করা আমাদের দরকার। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পরই আমরা সভার তারিখ ঘোষণা করব। তুমি আমাদের সংগঠনের জন্য অত্যন্ত উদ্যমের সঙ্গে ও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছ জেনে আমি অত্যন্ত সুখী। এখানে আমরা গণপরিষদে আমাদের সংগ্রামের ব্যাপারে ব্যস্ত। কারণ আমরা জানি যে, আসন্ন সংগ্রামের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শহীদ সাহেব ছাড়া আমাদের পার্টির সব সদস্যই ২ ও ৩ মার্চ অথবা কাছাকাছি সময়ে ঢাকার পৌঁছুবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খবর তোমাকে দেব।
দয়া করে মাওলানা সাহেবকে জানিও যে আমি তাঁর টাকা নিয়ে আসছি। আমাদের সকল কর্মীর প্রতি রইল আমার প্রীতি ও সালাম।
আশা করি তুমি ভালো আছ।
তোমারই
মুজিব ভাই
চিঠি-৫: আবুল ফজলকে
ফোন: ২৪২৫৬১
৬৭৭ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা
রোড নং ৩২, ঢাকা।
তারিখ: ১৭-১১-৬৯ ইং
জনাব অধ্যাপক সাহেব,
আমার ছালাম গ্রহণ করবেন। আশা করি ছহি-ছলামতে আছেন।
সম্প্রতি ইত্তেফাকে প্রকাশিত আপনার প্রবন্ধ ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার সাবলীল লেখনী নিঃসৃত সৃজনশীল এই প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে অধিক সংখ্যক মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। প্রবন্ধটি আমি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতে মনস্থ করেছি। আপনার অনুমতি পেলে কৃতার্থ হব।
আপনার স্নেহের
শেখ মুজিব
আরও পড়ুন
-
নাইজারে মার্কিন বাহিনীর অবস্থান থাকা ঘাঁটিতে রুশ সেনাদের প্রবেশ
-
প্রথম টি–টোয়েন্টি: তানজিদের অভিষেক, টস জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
-
সফর বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে তিন মাসেই বিদেশ গেলেন প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন
-
উপজেলা চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে বদির গুলি, থানায় অভিযোগ
-
আমেথি থেকে সরে শেষ মুহূর্তে কেন রায়বেরেলি থেকে প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল