
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, একাত্তরে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে মূল ভূমিকা পালনকারী, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব আর নেই। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর গতকাল বুধবার সকালে দিল্লির একটি সামরিক হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, জ্যাকব ফ্রেডারিক রালফ জ্যাকব (জে এফ আর জ্যাকব) একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তখন তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধকালে জ্যাকব ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জেনারেল জ্যাকবের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন সংগঠনও শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে।
জেনারেল জ্যাকব ছিলেন একজন কুশলী সেনানায়ক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব অনেকটাই বর্তেছিল তৎকালীন এই মেজর জেনারেলের ওপর। তিনি নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে রণাঙ্গনে এগিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়া তৈরি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখন, কোথায় ও কীভাবে আত্মসমর্পণ করবে—এসবই তাঁর তত্ত্বাবধানে ঠিক করা হয়েছিল।
জ্যাকবের লেখা সারেন্ডার ইন ঢাকা, বার্থ অব এ নেশন এবং অ্যান ওডিসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস বই দুটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণা রয়েছে।
১৯২৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন জ্যাকব। ১৯ বছর বয়সে ব্রিটিশ সরকারের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭৮ সালে অবসরে যান। সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সাহসিকতার জন্য পেয়েছেন নানা পদক।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিলে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ আরও ৮৩ জনের সঙ্গে জ্যাকবও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নেন। এর আগে ২০০৮ সালের মার্চেও সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর জেনারেল জ্যাকব গোয়া ও পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে অনবদ্য অবদানের জন্য জাতি জ্যাকবের প্রতি সব সময় গভীরভাবে কৃতজ্ঞ থাকবে।
প্রথম আলোর সঙ্গে জেনারেল জ্যাকবের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ৯০ বছর বয়সেও তিনি ইন্টারনেটে সক্রিয় ছিলেন। ‘আমি ভালো আছি’ জানিয়ে তিনি সর্বশেষ ই-মেইল করেছিলেন ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে। ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যাকব বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইন্দিরার (ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) জীবনের সর্বোত্তম মুহূর্ত। আর বাংলাদেশ মূলত ছিল জনগণের সংগ্রাম, ভারত তাতে সহায়তা করেছে মাত্র।
শোক ও শ্রদ্ধা: ভারতের এই কৃতী সাবেক সেনানায়কের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শোক প্রকাশ করা দল ও সংগঠনের মধ্যে রয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাসদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ বিভিন্ন সংগঠন।
গতকাল এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বাঙালি জাতি জেনারেল জ্যাকবকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ‘আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক বীর সৈনিককে হারিয়েছি। জাতি মুক্তিযুদ্ধে জ্যাকবের অবদানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ করবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, জেনারেল জ্যাকব ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার মুক্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।