গণতন্ত্র

বিচারকের স্বাধীনতা

আমিরুল কবির চৌধুরী
আমিরুল কবির চৌধুরী

শেক্সপিয়ার মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ বলেছিলেন, একজন সৎ ও মর্যাদাবান বিচারকই একজন বিজ্ঞ বিচারক। এই স্মরণীয় উক্তির আলোকে আমি বিচারকের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।

বিশ্ব আজ স্বাধীনতায় উচ্চকিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখো কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বেদনার মধ্য দিয়ে আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু কেবল স্বাধীনতাই সবকিছু হতে পারে না। স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখা এবং তাকে নিরাপত্তা দেওয়া প্রয়োজন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বাধীনতা বেঁচে থাকতে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে সরকার কতিপয় লোকের অধীনে নয়, আইনের অধীনে হতে হবে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আইনের শাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া আইনের শাসন একটি স্বপ্ন হয়ে থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা উৎসারিত হয় ক্ষমতার পৃথক্করণ থেকে। গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে এমনকি দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে এই পৃথক্করণ অপরিহার্য। এর সারকথা হলো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সেটাই আজকের সবচেয়ে বড় দাবি। সংক্ষেপে বলতে হয় রাজার ক্ষমতা সীমিত করার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতার যে রক্ষাকবচ, সেটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মতবাদ থেকেই এসেছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেবল তখনই সম্ভব, যখন সরকারের ক্ষমতা সংযত ও সীমিত থাকবে।

স্বনামধন্য ফরাসি পণ্ডিত মন্টেস্কু তাঁর দ্য স্পিরিট অব দ্য লজ গ্রন্থে বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা আমাদের অনবরত দেখাচ্ছে যে প্রত্যেক ব্যক্তি, যাঁর হাতে ক্ষমতা রয়েছে, তিনি তা সুকৌশলে অপব্যবহার করে চলেন এবং তাঁকে রুখে না দেওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর কর্তৃত্বপরায়ণতা বজায় রেখে চলেন।’ একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এখানে রাশ টানতে পারেন বিচারকেরা। কারণ, ন্যায়সংগত বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাঁদেরই। সে কারণে বিচারকের স্বাধীনতা দরকার এবং এর সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং বর্তমান যুগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই।

তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করা বা এটা বলতে কী বোঝায় তা সংক্ষেপে বোঝানো কঠিন। এর আক্ষরিক অর্থ হলো নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপসহ বাইরের যেকোনো নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব থেকে তার স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়া। সে কারণেই সংবিধানে ক্ষমতার পৃথক্করণ স্বীকৃত। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিচারকের কর্মমেয়াদ, বিচারকের আর্থিক এবং প্রশাসনিক নিরাপত্তা।

রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিচার বিভাগকে অবশ্যই সংবিধান এবং আইনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী ন্যায়সংগত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ঘটলে তা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিমূলে গুরুতরভাবে আঘাত হানতে পারে, যা কখনো গণতন্ত্রকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে যোজন যোজন দূরবর্তী একটি মুখোশসর্বস্ব গণতন্ত্রে পরিণত করতে পারে।

আজকের দিনে রাষ্ট্র নিজেই তার নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। অন্যদিকে অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমা রুজু হয়ে থাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বিপন্ন করার মতো ঘটনা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘটানো হচ্ছে। নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গলদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে আইনের শাসনের নীতির যথার্থ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পূর্বশর্ত।

এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিচারলাভের আকাঙ্ক্ষা মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। কিন্তু বিচার কেবল আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদালতই দিতে পারেন। আর ন্যায়সংগত বিচার পেতে হলে আদালত ব্যবস্থা অর্থাৎ বিচার বিভাগকে অবশ্যই হতে হবে নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং সাংবিধানিক কর্তৃত্ব দ্বারা কার্যকর। বিচার বিভাগকে অবশ্যই উচ্চ মানসম্পন্ন, সাহসী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, একাগ্রচিত্ত স্বাধীন এবং পক্ষপাতমুক্ত মনের মানুষ দ্বারা সংগঠিত করতে হবে। তখনই প্রশ্ন আসে একজন বিচারককে তাঁর আসনে বসানোর আগে কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাছাই করা হবে।

বিচারের দরজা সবার জন্য খোলা

আমাদের সংবিধানে বিভিন্ন অনুচ্ছেদের অধীনে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতার রূপদান করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করা হয়ে থাকে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করতে আমাদের বিচার বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় মাইলফলক রায় দিয়েছেন। সেই রায়ে ভারতীয় ও কানাডীয় বিচারিক দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করে আমাদের আপিল বিভাগ অভিমত দিয়েছেন যে বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ এবং ১১৬ক অনুচ্ছেদের মধ্যে যেভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, তা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। সংবিধানের অধীনের বিধানাবলি ছাড়া এই স্বাধীনতাকে ধ্বংস, হ্রাস, কর্তন কিংবা বিনাশ করা যাবে না। আরও বলা হয়েছে যে সংবিধানের ১১৫, ১৩৩ অথবা ১৩৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদ কিংবা রাষ্ট্রপতিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হ্রাস করার কোনো কর্তৃত্ব দেয়নি। সংসদ বা রাষ্ট্রপতি কোনোভাবেই কোনো ধরনের অধীনস্থ আইন বা বিধিবিধান দ্বারা এর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবেন না, আর যা সরাসরি করা যাবে না, তা তাঁরা পরোক্ষভাবেও করতে পারবেন না।

মাসদার হোসেন মামলা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে বিচারকদের চাকরির শর্তাবলি, বেতন, তাঁদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশ বনাম মোহাম্মদ আবু বকর (৫৭ ডিএলআরএডি ১৮৬) মামলায় দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই একজন হাকিমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। আমাদের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের আওতায় (ঘটনাক্রমে আমি ছিলাম ওই রায়ের লেখক বিচারক) দেওয়া ওই রায়ে বলা আছে, ১১৬ অনুচ্ছেদের আওতায় আমাদের অভিমত হচ্ছে বিচারিক কর্মরত কোনো হাকিমের বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিতে হলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করতে হবে। ওই মামলায় সরকারের পদক্ষেপ এই যুক্তিতেই নাকচ হয়ে গিয়েছিল।

আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধানের জন্য দরকার মেধাবী, সৎ, আপসহীন, সাহসী এবং এমন ব্যক্তিদের, যাঁরা সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত থাকবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে তাঁরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে দুর্যোগের মধ্যে পড়তে পারেন। কিন্তু তাঁরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, সেটা এক চিরকালীন উজ্জ্বল আলোক-সংকেত হয়ে থাকবে। এ প্রসঙ্গে আমাকে বহু বছর আগের একজন মহান বিচারকের নাম উল্লেখ করতে হচ্ছে। ইংল্যান্ডের রাজা জেমস তখন মসনদে। সেই সময় স্যার এডওয়ার্ড কোক বিচারকের স্বাধীনতা সমুন্নত রেখেছিলেন। রাজা ও বিচারকদের মধ্যে একটা সংঘাত দেখা দিয়েছিল। রাজা বলেছিলেন, বিচারকেরা রাজার সঙ্গে সলাপরামর্শ না করে কোনো রায় ঘোষণা করবেন না। স্যার এডওয়ার্ড কোক দৃঢ়তার সঙ্গে এটা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘রাজার নির্দেশের প্রতি আনুগত্যের কারণে বিচারিক প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা মানে বিচার বিলম্বিত করা। আর সেটা আইন এবং বিচারকের শপথের পরিপন্থী।’

রাজা ১২ জন বিচারকের প্রতি প্রশ্ন করলেন যে রাজা যখন বিশ্বাস করবেন যে কোনো বিষয়ের সঙ্গে তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং বিচারকদের তরফ থেকে উপদেশ নেওয়া প্রয়োজন, তখন কি তাহলে সেই পরামর্শ প্রদান না করা পর্যন্ত বিচারিক প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা উচিত নয়?

স্যার এডওয়ার্ড কোক ব্যতিরেকে সব বিচারকই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। স্যার এডওয়ার্ড কোক উত্তর দিলেন, ‘সেটা যখন ঘটবে তখন একজন বিচারকের জন্য যা করণীয় আমি ঠিক তা-ই করব।’ স্যার এডওয়ার্ড কোককে রাজা অপসারণ করলেন। কিন্তু কোকের সেই আচরণ ইংল্যান্ডের জনগণের দ্বারা চিরকাল সমাদৃত হয়ে আসছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুরক্ষা থেকে ফলাফল লাভের জন্য নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ সংবিধিবদ্ধ পৃথক্করণ প্রয়োজন। বিচারক নিয়োগ এবং তাঁদের ও তাঁদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপসারণের প্রতিটি ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সাংবিধানিক নিশ্চয়তাও থাকতে হবে, যাতে তাঁরা সরকারের কোনো প্রকারের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়াই নিজস্ব বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারেন। অবসরের পর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকতে হবে, যাতে অবসরের পর বিচারকদের কোনো ধরনের চাকরির প্রয়োজন না হয়। এবং তৎউদ্দেশ্যে কোনো চাকরি লাভের সুযোগ নিষিদ্ধ করতে হবে।

আমাদের মূল সংবিধান অনুসারে ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের বিধান ছিল। কিন্তু সংশোধনীর পর রাষ্ট্রপতি এখন প্রধান বিচারপতি ও অন্য দুই জ্যেষ্ঠ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচারকদের অপসারণ করতে পারেন। অর্থাৎ এই কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী যদি কোনো বিচারক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে অযোগ্য বিবেচিত হন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দোষে দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বিচারককে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করতে পারেন। সাম্প্রতিক কালে আমরা অবশ্য মূল সংবিধানের ৯৬(২) অনুচ্ছেদটি পুনরুজ্জীবনের দাবির ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, যা বাস্তবায়িত হলে আমার অভিমতে বিচার বিভাগের জন্য আত্মঘাতী হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি প্রহসনে পরিণত হবে। উপসংহারে বলা যায়, গণতন্ত্রের লালন ও তাকে নিরাপত্তা দিতে বিচারকের স্বাধীনতা অপরিহার্য।

আমিরুল কবির চৌধুরী: সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক; জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান