
কয়েক বছর আগে উদ্ভিদবিষয়ক একটি ফিল্ড গাইড তৈরির কাজে কিছু ছবি ও তথ্য-উপাত্তের খোঁজে দেশের অনেক বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার অনুসন্ধানের তালিকায় এই খুদি খেজুরও ছিল। তারও আগে একেবারে পরিকল্পনা পর্যায়ে সম্ভাব্য উদ্ভিদের তালিকায় নামটি সংযুক্ত করতে গিয়ে এর কিছু প্রাথমিক তথ্যও জানা হয়। কিন্তু জানা ছিল না গাছটির অবস্থান। অথচ গাছটির তথ্য ও ছবি ফিল্ড গাইডে সংযুক্ত করতে হবে।
গাছটির প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহের অন্তত দুটি কারণ বলতে পারি। প্রথমত, খেজুরগাছ আমরা অনেকেই চিনি, কিন্তু খুদি খেজুর সে তুলনায় একেবারেই অচেনা। দ্বিতীয়ত, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থে গাছটিকে বিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের প্রকৃতিতে জন্মানো এমন একটি বিপন্ন বুনো উদ্ভিদ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা থাকা প্রয়োজন।
অবশেষে গাছটির সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী শামসুল হক। তিনি জানান, গাজীপুরের শালবন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছ আছে। শালবনের ঠিক কোন অংশে গাছগুলো পাওয়া যাবে, তা-ও তিনি জানিয়ে রাখলেন। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে ফলের মৌসুম হিসাব করে উপস্থিত হলাম সেখানে। স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতায় পৌঁছে গেলাম কাছাকাছি অবস্থানে। ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ—সুদর্শন ভুঁইচাঁপা ও হলদে ফুলের একটি পানা। গাছগুলো আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত খুদি খেজুর তখনো অধরা। যেতে হলো বনের আরেকটু গভীরে। পায়ের তলায় শুকনা পাতার ঝনঝন শব্দে বনের নৈঃশব্দ্য বিঘ্নিত হলো। তা হোক, তখন ধ্যানী ঋষির মতো একাগ্রচিত্তে শুধু খুদি খেজুরের জপ করছি।
অনেকটা হঠাৎ করে মনে হলো যেন চোখ খুলতেই সামনে হাজির হলো গাছটি। প্রথমে বিক্ষিপ্ত দু-একটি, পরে আরও কয়েকটি। চারপাশে তাকিয়ে উপলব্ধি হলো, আসলে বন বলতে যা বোঝায়, জায়গাটি ঠিক তেমন কিছু নয়। নতুন প্রজন্মের ৮-১০ ফুট উঁচু কয়েকটি শালগাছ ছড়ানো, পরিচ্ছন্ন বনতল, তেমন কোনো তৃণ-গুল্ম নেই। ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কিছুদিন আগে বনে আগুন লাগানো হয়েছিল। কিছু দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ গাছ নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। এত সব উপদ্রবের মধ্যেই খেজুরগাছগুলো টিকে আছে। তবে সংখ্যার বিচারে যা একেবারেই নগণ্য। কোনো কোনোটিতে ফলও ধরেছে। বেশ কিছু ছবি তুললাম। শঙ্কিতও হলাম, নিকট ভবিষ্যতে গাছগুলো হয়তো নিশ্চিহ্ন হবে। পরে অবশ্য শালবনের অন্যান্য অংশেও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছ দেখেছি।
খুদি খেজুর (ফনিক্স অ্যাকাউলিস) ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার শালবনে দেখা যায়। এটি কাণ্ডবিহীন বামনাকৃতির পামগাছ। পাতা সরু, চোখা ও কিনারা অন্তর্মুখী বাঁকানো। ফুল ছোট, হলুদাভ ও পুরু এবং তির্যক ডিম্বাকার পাপড়িসংখ্যা তিন। এদের পুংকেশর ছয়টি। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল পৃথক। ফল এক বীজবিশিষ্ট। বীজ থেকে চারা হয়। গাছের গড়ন, ফল ও পাতা দেশি খেজুরের মতো হলেও তুলনামূলকভাবে বেশ ছোট। ফুল ও ফলের মৌসুম বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ। ফল শিশু ও পাখিদের প্রিয়। এ গাছের আবাসস্থল নেপাল, ভুটান ও ভারতের বিহার এবং ছোট নাগপুর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতায় এ গাছ জন্মে। গাছটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। শালবনের যেসব এলাকায় খুদি খেজুর দেখা যায়, সেসব এলাকায় বিশেষ নজরদারি দরকার।