Thank you for trying Sticky AMP!!

বুকের ভেতর হাহাকার অনুভব করছেন রাজীবের চিকিৎসকেরাও

মো. শামসুজ্জামান

গত ১৩ দিন ধরে রাজীব হোসেনের সঙ্গে ছিলেন তাঁরা। রাজীবকে নিয়ে দেশবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাঁদেরও স্পর্শ করেছিল। দুর্ঘটনার পর যেন এই জগৎ-সংসারের ওপর অভিমান চেপে বসেছিল রাজীবের। হাসপাতালে যখন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও কথা বলেননি, তখন চিকিৎসকদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন তিনি। শুরুতে রাজীবের জীবনাশঙ্কা ততটা না থাকলেও গত এক সপ্তাহে তাঁর নিয়তি যেন নির্ধারিতই হয়ে গিয়েছিল। এরপরও গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে রাজীবের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে হাহাকার করেন অনেকে। বুকের ভেতর এমন হাহাকার অনুভব করেছেন তাঁর চিকিৎসকেরাও।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান ও রাজীবের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আপনারা একটু লেখালেখি করেন। এমন মৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের, রাষ্ট্রের।’

৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব (২১)। তাঁর ডান হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শমরিতা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। সাময়িক উন্নতির পর গতকাল থেকে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রাজীবের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। গতকাল দিবাগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজীব মারা যান।

আজ মঙ্গলবার অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান সাংবাদিকদের কাছে রাজীবের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘রাজীব নেই। আমরা খুব কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু রাজীবের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ত্রুটির কারণে এমন মৃত্যু, সেই ত্রুটিগুলো সারানো দরকার। আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হয়ে আসতেন। এখন এই সংখ্যা অনেক বেশি। এই যে আজ ভর্তি হয়েছে একটি বাচ্চা। জীবন বাঁচাতে তার পা কেটে ফেলতে হলো।’

রাজীবের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাস চালকের শাস্তির দাবিতে আজ বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন যাত্রী অধিকার আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। ছবি: জিয়া ইসলাম

রাজীবের মৃত্যুর জন্য সড়ক দুর্ঘটনাকে দায়ী করে তা প্রতিরোধে প্রত্যেককে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান শামসুজ্জামান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই যে রাজীব, খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা-মা নেই। সংগ্রাম করে জীবন চালাচ্ছিল। ছোট ছোট দুটি ভাই।’

রাজীবকে হাসপাতালে আনার পর থেকে চিকিৎসকদের তৎপরতার কথা তুলে ধরে শামসুজ্জামান বলেন, ‘যেদিন প্রথম আলোয় ওর (রাজীব) ছবি ছাপা হলো, সেদিন সকালেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবে হোক ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসতে হবে। ততক্ষণে ওর অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। আমরা বললাম আউটডোর দিয়ে আসতে সময় লাগবে, জরুরি বিভাগ দিয়ে দ্রুত ভর্তির ব্যবস্থা করলাম। বোর্ড হলো। দেখলাম, অস্ত্রোপচারটা ভালো হয়েছে। শমরিতায় যে করেছে, ও আমাদেরই সহকারী অধ্যাপক। দেখলাম ওর (রাজীব) মাথার সামনের দিকে আঘাত রয়েছে। সাতজনের বোর্ডে দুজন নিউরোসার্জন ছিলেন। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়েও আলোচনা করলাম। সিটি স্ক্যান রিপোর্ট ভালো। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়নি।’

শুরুতে রাজীবের প্রাণহানির আশঙ্কা ততটা ছিল না উল্লেখ করে শামসুজ্জামান বলেন, ‘রাজীব সে সময় স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। আমরা চিকিৎসায় সারিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। সবই ঠিকঠাক। গত সপ্তাহের সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত সব ঠিক। রোগী ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠছে। সেদিন বিকেলে করা সিটি স্ক্যান রিপোর্ট তা-ই বলে। পরদিন মঙ্গলবার ভোর চারটায় ওর শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল। কোনো কারণে গলায় কিছু বেঁধে গেল কি না, তা-ও দেখা হলো। পরে নেবুলাইজেশন দেওয়া হলো। রাজীব স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিল। এরপর আবারও খারাপ হতে শুরু করল। আমরা ওকে ভেন্টিলেশনে দিলাম। আমরা ওর ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। দ্রুত সিটি স্ক্যান করা হলো। কী বলব! আগের দিনের রিপোর্টের ঠিক উল্টো। একদম খারাপ।’

শামসুজ্জামান বলেন, ‘ওর (রাজীব) মস্তিষ্ক এত ভালো কাজ করছিল যে আমরা অপারেশনে যাইনি। আর যখন খারাপ হলো, এত খারাপ হলো যে অপারেশনের আর সুযোগ পাওয়া গেল না। মস্তিষ্কের যে অংশটা অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে সেটা চাপ খেয়েছিল। মাথার সামনের দিকের আঘাতের জন্য ওই অংশটা ফুলে উঠেছিল। মাথার মাঝখানটা কাজ করতে পারছিল না। বিএসএমএমইউর ভিসি কনককান্তি স্যার নিজে এলেন। দেখে বললেন, এখন অস্ত্রোপচারে আর কাজ হবে না। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’

এরপরও আশা ছেড়ে দেননি জানিয়ে অধ্যাপক শামসুজ্জামান বলেন, ‘আমি আশায় ছিলাম। অল্প বয়স, হয়তো ফিরবে। আমরা ওর কিডনি, ফুসফুস, হৃদ্‌যন্ত্রটা যেন ঠিকভাবে কাজ করে, সেদিকে নজর দিচ্ছিলাম। ঠিকঠাক কাজ করছিলও। বৃহস্পতিবার কিডনিটা ঠিকমতো কাজ করছিল না। পরে সেটাও ঠিক হলো। গত পরশু দেখলাম, জ্বর। ফুসফুসে প্রদাহ থেকে জ্বরটা এসেছিল। এই লক্ষণ খুব খারাপ।’

শামসুজ্জামান বলেন, ‘শেষ সময়ে সাপোর্ট দেওয়ার পরও ফুসফুস কাজ করছিল না। ফুসফুস রক্তে অক্সিজেন নিতে না পারলে হৃদ্‌যন্ত্র কাজ করে না। একসময় হৃদ্‌যন্ত্রটা বিকল হয়ে গেল। মারা গেল রাজীব। ওর মস্তিষ্কটা যদি ধীরে ধীরে অসাড় হতে থাকত, তবু চেষ্টা করা যেত। হরদম ঢাকা মেডিকেলে এমন অস্ত্রোপচার হচ্ছে। এক ঘণ্টা লাগে এমন অস্ত্রোপচারে। সব প্রস্তুতি ছিল, রাজীব সুযোগটাই দিল না।’