নদী বাঁচাতে চট্টগ্রামের মেয়রের সহযোগিতা চাইলেন নৌমন্ত্রী

বুড়িগঙ্গার পথে কর্ণফুলী!

দখল ও দূষণে কর্ণফুলী নদীর প্রাণ যেতে বসেছে। সিটি করপোরেশনের বর্জ্য, পয়োবর্জ্য এবং নদীপাড়ের ১৩৩টি কারখানা এই দূষণের জন্য দায়ী। দখলদারদের তালিকায় রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এই অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর মতো পরিণতি হতে পারে কর্ণফুলীর।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর নাব্যতা এবং নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা–সংক্রান্ত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স কমিটির
৩০তম সভায় কর্ণফুলীর বেহাল অবস্থার কথা উঠে আসে। গতকাল শনিবার চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে এ সভা হয়।
সভায় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কর্ণফুলী নদীর পরিণতি বুড়িগঙ্গার মতো হতে পারে। কর্ণফুলীর দখল ও দূষণ রোধে শুরু হওয়া অভিযানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
তবে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কচ্ছপ গতিতে এগোনো হয়। সব দখলদারকে উচ্ছেদে সততা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ তারা প্রভাবশালী। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের ২৬তম সিদ্ধান্তের বিষয়টি টেনে মেয়র বলেন, ওই সভায় কর্ণফুলী দখল ও দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে অনেক সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবায়নের অগ্রগতি কম।
সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রইছুল আলম বলেন, কর্ণফুলী দূষণের জন্য ১৩৩টি কলকারখানা দায়ী। এর মধ্যে ১২৩টি কারখানার কাগজে–কলমে বর্জ্য শোধনাগার থাকলেও সব সময় তা চালু থাকে না। বর্জ্য শোধনাগার না থাকা ১০টি কারখানার মধ্যে পাঁচটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। কর্ণফুলী দূষণের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়ার বলেন, বর্তমানে কর্ণফুলীর পাড়ে এবং নদীতে ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। অবৈধ দখলদার রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার।
গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, জোয়ার–ভাটা আছে বলেই কর্ণফুলী নদী এখনো বেঁচে আছে। পয়োবর্জ্য, সিটি করপোরেশনের বর্জ্য গিয়ে পড়ে কর্ণফুলীতে। কর্ণফুলী বাঁচাতে এখনই নজর দেওয়া দরকার।
কর্ণফুলী নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া। ২০০৯ সালে করা তাঁর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দূষণের কারণে নদীর প্রায় ৪৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে মঞ্জুরুল কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখন অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। দিন দিন দূষণ বাড়ছে। বেড়েছে অবৈধ দখলও। সভায় শুধু সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হলে নদীটি মরে যাবে।
দূষণের বিষয়ে নৌমন্ত্রী বলেন, ‘নদীকে দূষণমুক্ত করার জন্য আমরা একটু সময় নিয়েছি। কারণ হলো, দূষণ এক দিনে যেমন হয়নি,
তেমনি এক দিনে দূষণমুক্ত করা যাবে না। আমরা এ জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করেছি।’
নৌমন্ত্রী বলেন, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে এক হাজার কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও উদ্ধারের কাজ চলছে। তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সিএস জরিপের (ক্যাডেস্টাল সার্ভে) ভিত্তিতে নদীর সীমানা নির্ধারণ হবে। প্রয়োজনবোধে আরএস জরিপের (রিভাইস সার্ভে) সহযোগিতা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম বলেন, ‘নদী রক্ষার জন্য আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আদালতের নির্দেশে সিএস জরিপ ধরে এখন নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী উচ্ছেদ কার্যক্রমও চলছে।’
সভায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক, নৌমন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব অশোক মাধব রায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিশনের সভা: টাস্কফোর্সের সভা শেষে একই স্থানে দুপুরে বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিশনের সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমীন। প্রধান অতিথি ছিলেন নৌমন্ত্রী। সভা পরিচালনা করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম।
এই সভায়ও চট্টগ্রামের নদ-নদী রক্ষায় আগের সভার সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি হালদা নদীকে লবণাক্ততা এবং দূষণমুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন নৌমন্ত্রী।