বৃদ্ধ নারীদের পাশে ফটো আপা

সুলতানা শামীমারা বেগম
সুলতানা শামীমারা বেগম

তাঁর পেশা শিক্ষকতা। নেশা বৃদ্ধ নারীদের সহায়তা করা। প্রতিদিন পাড়া-মহল্লায় গিয়ে অসহায় বৃদ্ধ নারীদের খোঁজখবর নেন। তাঁদের সমস্যার কথা শোনেন। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে মাথায় তেল দেওয়া, চুল আঁচড়ে বেণি করে দেওয়ার কাজ সেরে ফেলেন।
তাঁর প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বৃদ্ধ নারী উপকৃত হয়েছেন। উপকারভোগী নারীদের নিয়ে তিনি সাপ্তাহিক বৈঠক করছেন। এভাবেই নয় বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন সুলতানা শামীমারা বেগম (৫২)। এলাকায় তিনি ‘ফটো আপা’ বলেই বেশি পরিচিত। বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা সদর ইউনিয়নের কচুয়াহাট গ্রামে।
শামীমারা বেগমের বাবা শামছুজ্জোহার ইচ্ছা ছিল মেয়ে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে। কিন্তু তিনি চিকিৎসক হতে পারেননি। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি বৃদ্ধ নারীদের কল্যাণে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন সকালে পাড়া-মহল্লায় গিয়ে অসহায় বৃদ্ধ নারীদের খোঁজ নেন। তারপর যাঁর যেমন চাহিদা, সে অনুযায়ী সমাধান করে দেন।
বিশেষত যাঁর স্বামী নেই, ছেলেমেয়েরা ভাত-কাপড় দেন না, থাকার জায়গা নেই, এমন বৃদ্ধ নারীদের নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দেন। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অনুরোধ করে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ২০০৭ থেকে চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০০ বৃদ্ধ নারীকে সহায়তা করেছেন। সহায়তা দেওয়ার পর তাঁরা কেমন আছেন, তা তদারক করতে তাঁদের সঙ্গে সাপ্তাহিক বৈঠক করেন। শামীমারা বলেন, ‘আমার কলেজশিক্ষক স্বামীর টাকায় সংসার চলে। আর নিজের বেতনের টাকা বৃদ্ধ নারীদের পেছনে ব্যয় করছি।’
ফটো আপার সহায়তায় উপকৃত হয়েছেন কচুয়াহাট গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৬৪)। তিনি বলেন, ‘হামার সোয়ামি ও একন্যা ব্যাটা আচিলো। তামরা মরি গ্যাচে। মানসের বাড়িত কাম করি দুই নাতিক নিয়া চারজনের সোংসার চলাচি। হামার দুকের কতা শুনি ফটোক আপা বিদুবা (বিধবা) ভাতার কার্ড করি দিচে।’
অপর দিকে শামীমারা বেগম নিজের টাকায় বাড়ির পার্শ্ববর্তী ধনারুহা গ্রামে ১১ শতক জমি কিনেছেন। ওই জমিতে প্রায় ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে শৌচাগারসহ আধা পাকা বড় ঘর নির্মাণ করেন। ২০১৩ সালে এখানে গড়ে তোলেন বৃদ্ধাশ্রম। নাম দেন ডা. শামছুজ্জোহা মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রম। টাকার অভাবে তিনি এখনো এটি চালু করতে পারেননি।
কচুয়াহাট গ্রামের ইউপি সদস্য মজদার রহমান বলেন, ‘যে কাজ জনপ্রতিনিধির করার কথা, সে কাজ ফটো আপা করছেন। এ জন্য আমরা সব সময় তাঁকে উৎসাহ দিই।’ সাঘাটা সদর ইউপির চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শামীমারার প্রচেষ্টায় বৃদ্ধারা উপকৃত হচ্ছে। তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগানোর পাশাপাশি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’
শামীমারা বেগম বলেন, ‘বয়স বেশি হলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের কাছে অনেকটা অবহেলিতও হন। তাই বৃদ্ধাদের জন্য কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে বৃদ্ধ নারীদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছি না।’
সুলতানা শামীমারা বেগম কচুয়াহাট শহীদ এইচআরএম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তাঁর স্বামী আবদুর রাজ্জাক মণ্ডল সাঘাটা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক।
বৃদ্ধ নারীদের সহায়তার পাশাপাশি তিনি বাল্যবিবাহ রোধ, গ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং সামাজিক কাজের জন্য জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৩টি পুরস্কার পেয়েছেন।