
কবি এসেছিলেন, গান লিখেছিলেন। কিছুদিন ছিলেনও পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল এখন সেখানে একটি গুদামঘর ছাড়া কবির কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। কাজী নজরুল ইসলাম যে একদা এই এলাকায় এসেছিলেন, এলাকাবাসীও সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না।
চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত তাঁর দোলন-চাঁপার হিন্দোল গ্রন্থে নজরুলের বেচারাম দেউড়িতে অবস্থান সম্পর্কে লিখেছেন। অনুপম হায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯২৬-এর দিকে নজরুল নির্বাচনের কাজে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন সৈয়দ ইউসুফের বাড়িতে ছিলেন।’
গতকাল শুক্রবার বেচারাম দেউড়ির পায়রা চত্বরের কাছে গিয়ে কয়েকজনকে ‘কবি নজরুল এখানে কোন বাড়িতে ছিলেন?’ জিজ্ঞেস করলে কেউ কিছু বলতে পারেননি। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. শাহিন একটি গুদামঘর দেখিয়ে বললেন, ‘শুনেছিলাম এখানে ছিলেন। জাহাঙ্গীর সাহেবের বাড়ি যান, উনারা বলতে পারবেন।’
গুদামঘরের দিকে যেতে বাঁ পাশে একটি চায়ের দোকান। এর পেছনের বাড়িতেই যে নজরুল ছিলেন, এ বিষয়ে দোকানি জানেন কি না, জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘ক্যামনে জানুম, কিছু কি লেখা আছে?’
এ এম জাহাঙ্গীর বাড়ি পাওয়া গেল নজরুলের আবাসস্থল সেই গুদামঘর থেকে কয়েক শ গজ দূরে নুর বক্স লেনে। তিনি এখন ৯০-এর কোঠায়। শয্যাশায়ী। অনেক কথাই বোঝা যায় না। এ এম জাহাঙ্গীর স্থানীয় জমিদার আবুল খায়রাতের বংশধর। তাঁর ছেলে এ এম ইমরান শোনালেন নজরুলবৃত্তান্ত।
১৯২৫ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে কোনো এক সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম বেচারাম দেউড়ির আবুল খায়রাতের বাড়ি এসেছিলেন। আবুল খায়রাতের ভায়রা ছিলেন সৈয়দ ইউসুফ। তিনি কাশ্মীরের মানুষ। ঢাকায় বিয়ে করে এখানেই থেকে যান এবং পীর ইউসুফ নামে পরিচিতি পান। তাঁর দুই ছেলে ছিলেন সৈয়দ হোসাইনুর রহমান ও সৈয়দ আতাউর রহমান। এই দুই ভাইয়ের সঙ্গেই ছিল কবির বন্ধুত্ব। সেই সূত্রেই কবি এখানে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ছোট ছেলে আতাউর রহমানের সঙ্গে সখ্য ছিল ঘনিষ্ঠ। এখানে বেশ কিছুদিন ছিলেন। এ এম জাহাঙ্গীরের কিছু মনে আছে কি না জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি অনেক ছোট ছিলাম কিছুই মনে নেই।’ তিনি বড় হয়ে অন্যদের কাছে গল্প শুনেছেন।
এ এম ইমরান বলেন, এ এলাকা পুরোটা বাগান ছিল। বাগানটা কবি অনেক পছন্দ করেছিলেন। এখানে বসেই লিখেছিলেন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল।’ এ ছাড়া জানালেন ‘কে বিদেশী মন উদাসী/ বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে।’ গানটিও লিখেছিলেন। এ বাড়িতে বসে গান, গজল করতেন। দুই ভাইও তাঁর সঙ্গে সুর ধরতেন।
নজরুল যে ঘরটিতে ছিলেন, সেটি তালাবদ্ধ। টিনের চালার ঘরটিতে এখন ডেকোরেটরের জিনিসপত্র রাখা। পাশেই গুদামঘর। ঘরটির পেছন দিকে দেয়াল ঘেঁষে একটি বটগাছ। রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে ইমরান বলেন, ‘ঘরটি আমরা কিছুই করিনি। নজরুল ইনস্টিটিউট বলেছিল সংরক্ষণ করবে। কিন্তু পরে আর খোঁজ নেয়নি।’ তাঁরা চান নজরুলের স্মৃতির উদ্দেশে সরকার যেন এখানে কিছু করে। কবির প্রতি মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁরা মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করেন। জানালেন কবির ছেলে কাজী সব্যসাচীও এখানে এসেছিলেন।
নজরুল ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক শেখ রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, ‘এটা নিয়ে একটি প্রকল্পের কথা চলছে। আগামী বছরেই আমরা নিয়ে নেব।’
বেচারাম দেউড়িতে জাতীয় কবির স্মৃতি টিকে আছে ওই বাড়ির স্বজনদের চেষ্টায়। সরকারি উদ্যোগ না নিলে তা কত দিন থাকবে কে জানে।