আলু-ধান চাষে লোকসানের মুখে পড়ে ঠাকুরগাঁওয়ের চাষিরা গত কয়েক বছর ধরে ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের চক্রে পড়ে আশানুরূপ দাম পান না এসব সাধারণ চাষি। যখন দাম বাড়ে, তখন আর তাঁদের হাতে ভুট্টা থাকে না। ততক্ষণে সব চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে। লাভের গুড় তাঁরাই ভোগ করেন।
সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষক সুরেন্দ্র নাথ রায় (৫৪) বলেন, ‘এখানে ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ভুট্টার যে দাম হাকায়, আমাদের সে দামেই বিক্রি করতে হয়। আমাদের কাছ থেকে প্রতি মণ শুকনা ভুট্টা ৫৬০ টাকা দরে কিনে ব্যবসায়ীরা ফিডমিলে বিক্রি করেন অন্তত ৭৬০ টাকা দরে।’ প্রতি মণ ভুট্টার দাম ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা পেলে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কিছুটা উঠে আসত বলে কৃষক সুরেন্দ নাথ মত প্রকাশ করেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর গ্রামের ভুট্টাচাষি মো. ইসলাম (৪৫) বলেন, তিনি চলতি মৌসুমে এক বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করে ২৮ মণ ফলন পেয়েছেন। গত শুক্রবার লাহিড়ীহাটে নিয়ে যান কিছু ভুট্টা। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় ভুট্টা নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাঁকে।
সদর উপজেলার বরুনাগাঁওয়ের ভুট্টাচাষি মনিরুল হুদা (৪৭) বলেন, তিনি আগে ধান-আলুর চাষ করতেন। গত দু-তিন বছর ধরে একটু লাভের আশায় ভুট্টা চাষ করছেন। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কারণে তিনি এখন হতাশায় ভুগছেন বলে জানান। ওই কৃষক বলেন, ‘পাঁচ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করার পর এখন তা বিক্রি করতে পারছি না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি ভুট্টার বাজার। ব্যবসায়ীরা এক হয়ে উৎপাদিত ভুট্টার বাজারদর নির্ধারণ করে থাকেন। এরপর ওই দরে ভুট্টা কিনে গুদামজাতকরণ করেন। কৃষকেরা বাধ্য হয়েই কম দামে এসব ব্যবসায়ীদের কাছে ভুট্টা বিক্রি করে দেন। কৃষকের হাতছাড়া হলেই মণপ্রতি ভুট্টার দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে যায়।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ১১ হাজার ৭৩২ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭১ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বিঘায় ভুট্টা চাষে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। জমি বর্গা বা ইজারা নিয়ে চাষ করলে খরচ আরও পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বাড়ে। প্রতি বিঘায় গড়ে ৩০ মণ করে ভুট্টা পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতি মণ ভেজা ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৩৫০ টাকা ও শুকনো ভুট্টা ৫৬০ টাকা দরে। শুকানোর পর প্রতি মণে পাওয়া যায় ৩২ কেজি করে ভুট্টা। সদর উপজেলার ভুট্টা ব্যবসায়ী কাউসার আলী স্বীকার করেন কৃষকেরা বর্তমানে ভুট্টার যে মূল্য পাচ্ছেন, তা তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে প্রতি মণ ভেজা ভুট্টা ৩৫০ আর শুকনো হলে ৫৬০ টাকা দরে কিনছি। পরে তা শুকিয়ে ফিডমিলে বিক্রি করব। তখন এক মণ ভুট্টার দাম ৭৬০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’ তবে ব্যবসায়ীদের হাতে ভুট্টার বাজার জিম্মি বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।
জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন সরকার বলেন, ‘বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, ভুট্টাচাষিদের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য প্রায় সমান। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে কোনো নীতিমালা না থাকায় জেলার কৃষকেরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন। সরকারিভাবেও ভুট্টা কেনা হয় না। এ সুযোগে ফিডমিলগুলো সংগঠিত হয়ে ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে। তাদের ওপর নির্ভর করে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও ভুট্টার বাজারমূল্য ঠিক করেন।’ সরকারিভাবে ভুট্টা কেনা হলেই কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে মত প্রকাশ করেন আলাউদ্দিন সরকার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক আরশেদ আলী বলেন, দেশের পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণ ভুট্টা কেনার কথা, তা কিনছে না। এতে বাজারে প্রভাব পড়েছে। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকেরা ভুট্টা চাষ থেকেও সরে আসতে পারেন বলে আশঙ্কা করেন তিনি।