১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন

ভূপতিনাথের চিত্রকর্ম

ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর আঁকা চিত্রকর্ম l ছবি: প্রথম আলো
ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর আঁকা চিত্রকর্ম l ছবি: প্রথম আলো

দেয়ালে পাশাপাশি ঝোলানো দুটি তেলচিত্র। একটিতে একটি বাজারের দৃশ্য—মুরগি ও ডিমওয়ালার কাছ থেকে একটি মুরগি দরদাম করছেন এক ক্রেতা। পাশেই একটি চা-মিষ্টির দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন কয়েকজন। তাঁদের দুজন কাবলি পোশাক পরা। আরেকটি ছবিতে এক বয়স্কা বিধবা নারী চুল বেঁধে দিচ্ছেন এক তরুণীর।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিতে এই দুটি ছবি গ্রামবাংলার চিরকালীন আনন্দময় মুহূর্ত তুলে ধরছে। অথচ এই ছবিগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে এক বিষাদময় অধ্যায়। ছবিগুলো এঁকেছেন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গাঙ্গাটিয়া এলাকার একসময়কার জমিদার ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী। তিনি চিত্রকর ছিলেন। সংগীতচর্চাতেও ঝোঁক ছিল। ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে নিজ বাসায় হত্যা করে। যেভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা নিষ্ঠুরতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

শিল্প-সংস্কৃতিমনা ভূপতিনাথ ছবি আঁকার পাশাপাশি এসরাজ বাজাতে পারদর্শী ছিলেন। গাঙ্গাটিয়া এলাকায় তাঁর পরোপকারের গল্প এখনো মানুষের মুখে মুখে। তিনি হোমিও চিকিৎসায় পারদর্শী ছিলেন। বিনা পয়সায় মানুষকে হোমিও চিকিৎসা দিতেন। দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ তাঁর কাছে ছুটে আসত চিকিৎসা নিতে।

গত ২৯ নভেম্বর নিজ বাড়ির বৈঠকখানায় বসে প্রথম আলোর কাছে সেই দিনটির ঘটনা বলছিলেন ভূপতিনাথের ছেলে মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মে তাঁরা দুই ভাই, মাসহ সবাই বাড়িতে ছিলেন। ভূপতিনাথ সেদিন ছিলেন পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের সুধীর চন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়িতে আত্মগোপনে। সেখান থেকে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে এই বাড়িতেই নিয়ে আসে। এর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বুখারির নেতৃতে ৪০-৫০ জন সেনা বাড়িটি ঘেরাও করে রাখে।

মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাক মিলিটারিরা সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে বাবাকে ধরে আনে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত 

এই বাড়িতেই অবস্থান করেন তাঁরা। পরে মন্দিরের সামনে কদমগাছতলায় বাবা ও চাচাতো ভাই পঙ্কজ কুমার চক্রবর্তী চৌধুরীসহ চারজনকে দাঁড় করিয়ে হাতে বেঁধে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সময় আমরা ছুটে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। পরে পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে সন্ধ্যার পর বাড়িতে এসে পার্শ্ববর্তী পানান এলাকার হোসেন উদ্দিনের সহায়তায় বাবাকে বাড়িতেই সমাহিত করি।’

গ্রামের প্রতিবেশীদের বাড়িতে দেড় মাস লুকিয়ে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীসহ পরিবারের বাকি সদস্যরা। ইতিমধ্যে ভূপতিনাথের বাড়িঘর লুটপাট করে নিয়ে যাওয়া হয়।

ভূপতিনাথ কলকাতা আর্ট কলেজে পড়াশোনা করে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্য ছিলেন। বাড়িতে তাঁর বহু চিত্রকর্ম ছিল। লুটপাটের পাশাপাশি স্থানীয় রাজাকাররা এসব চিত্রকর্ম ধ্বংস করে ফেলে। তবে কলকাতায় ভূপতিনাথের মেয়ে বাসন্তীর বাড়িতে দুটি চিত্রকর্ম থাকায় সেগুলো রক্ষা পেয়েছে। মানবেন্দ্রনাথ সেই বিরল চিত্রকর্ম দুটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়েছেন।

মানবেন্দ্রনাথ বলেন, বাবাকে হত্যার পর তাঁকেও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর প্রায় দেড় মাস পর পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর ইফতেখার একদিন আমাকে কিশোরগঞ্জ শহরে ডেকে নেন। আমি স্থানীয় দুই লোকের সাথে মেজর ইফতেখারের সঙ্গে দেখা করতে খালি পায়ে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে শহরে যাই। তখন আমার বয়স ৩৪ বছরের মতো। মেজর ইফতেখার আমাকে দেখে হেসে বলেন, তুমি না জমিদার, তোমার এ কী অবস্থা! জবাবে আমি বলি, একটি গেঞ্জি ও লুঙ্গি ছাড়া আমার পরনের আর কিছু নাই। বাড়ির সব লুট হয়ে গেছে। মেজর ইফতেখার এ কথা শুনে বলেন, তুমি তোমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে শহরে চলে এসো। মেজরের মতলব আঁচ করতে পেরে আমি মেজরের কাছ থেকে এসেই দুই দিন পর সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে যাই। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে এসেছি।’

১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল মানবেন্দ্রনাথ পিতাসহ ওই দিন অন্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন বোখারি এবং তাদের সহযোগী স্থানীয় রাজাকার শাহনেওয়াজ মাস্টার, শাহজাহান ও মুখলেছুর রহমানকে আসামি করে স্থানীয় থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। স্থানীয় আসামিদের কেউ এখন বেঁচে নেই।