ভালোবাসা দিবস

ভ্যালেন্টাইনের ফাঁকি

ইরেশ যাকের
ইরেশ যাকের

শুধুই বন্ধু নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা—এই দ্বন্দ্ব কখনো কখনো জীবনে এসে যায়। তখন কী করা? সে বিষয়ে লিখেছেন অভিনয়শিল্পী ইরেশ যাকের।
১৪ ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে যেহেতু ভালোবাসা নিয়ে লিখতে বলা হয়েছে, ধরেই নিচ্ছি যে এই ভালোবাসা ক্রিকেট বা পরোটার জন্য ভালোবাসা নয়। শিহরণ জাগানো রোমান্টিক ভালোবাসা। শুধু ভালোবাসা নিয়ে অবশ্য লিখতে বলা হয়নি। ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব। ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক এক জুটি। কত হতভাগাই না এই দুই নৌকায় পা দিতে গিয়ে গভীর জলে পড়েছে। কত হতভাগাই না সে পানিতে নাকানি-চুবানি খেয়েছে। চিন্তা করলেই চোখে পানি চলে আসে। মনে পড়ে যায় ১৯৯৩ সালের কথা। কলেজে আমার ফার্স্ট ইয়ার।
তখন এক ছেলেকে চিনতাম। লেখাপড়ায় ভালো, গোলগাল, চশমা পরে। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি মোটা। সেই ছেলের একজন সহপাঠী মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। মেয়েটির কৈশোরের প্রেম সম্প্রতি ভেঙে গেছে মা-বাবার কারণে। তার আগে প্রেমের কারণে ক্লাসের বাকি সব বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া করায় তার তেমন বন্ধুও নেই। অন্ধকারের সাথি বলতে আমাদের সেই গোলগাল ছেলে। দিন-রাত ল্যান্ডলাইনে কথা হয়। একসঙ্গে কোচিং ক্লাসেও যায় দুজন। মোবাইল ও ইন্টারনেট-বিহীন যুগে বাবা-মায়ের কড়াকড়ির মধ্যে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের যতটা গলাগলি বন্ধুত্ব হতে পারে আর কি।
এই দ্রুত ফুটন্ত বন্ধুত্বের শুরুতেই মেয়েটি বলে দিয়েছিল যে কোনো ধরনের প্রেম হবে না। ছেলেটির বন্ধুরাও তাকে বলে দিয়েছিল প্রেমের স্বপ্ন না দেখতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মাস খানেক যেতে না যেতেই ভীষণ প্রেমে পড়ে গেল গোলগাল। প্রথম দিকে সে কয়েক দিন চেষ্টা করল ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু এই বয়সের ভালোবাসা কি আর লুকিয়ে রাখা যায়? যায় না। প্রতি মুহূর্তে ভেসুভিয়াস পাহাড়ের মতো ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। মহা যন্ত্রণা। তখন গোলগাল ভাবল, বন্ধুত্ব তো বেড়েই চলেছে, ইঙ্গিতে একটু বোঝানোর চেষ্টা করি। সায় দিলে তো ভালো আর যদি খেপে যায়, পুরো ব্যাপারটাই একটা ভুল-বোঝাবুঝি হিসেবে চালিয়ে দাওয়া যাবে। মেয়েকে সে ব্রায়ান অ্যাডামসের ‘ডু আই হ্যাব টু সে দ্য ওয়ার্ডস’-এর মতো অসাধারণ হূদয়বিদারক গান শোনায়। শুনিয়ে আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘গানটা একদমই আমার মনের কথা বলছে।’ জুলিয়া রবার্টস থেকে শুরু করে রাভিনা ট্যান্ডন পর্যন্ত সব সুন্দরির ছবি দেখিয়ে বলে, ‘দেখ দেখ, তোমার সঙ্গে কত মিল!’ মাস ছয়েকের হাতখরচের টাকা দিয়ে বেহুদা দামি গিফট দিয়ে বলে, ‘ভাবলাম বন্ধুর জন্য কিছু একটা করি।’ কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হয় না। না রাগলেও মেয়ে কোনো ধরনের উপলব্ধির চিহ্ন দেখায় না। ‘হ্যাঁ, আমারও গানটা ভালো লাগে। ওহ্ হ্যাঁ, আমি শ্যামলা না হলে জুলিয়া হতাম, ওহ্, তুই এত সুইট কেন। গুট্টু গুট্টু বন্ধুটা আমার।’ এ রকম নানা কথা শুনতে হয় গোলগালের। একপর্যায় বন্ধু কথাটার প্রতি ভয়ংকর অ্যালার্জি গড়ে ওঠে। বন্ধু কথাটিকে ভয় পেতে শুরু করে সে। মেয়ের মুখে বন্ধু বা দোস্ত শোনার আতঙ্কে সিন্দুকে লুকিয়ে থাকতে চায় সে। কিন্তু ভালোবাসার টানে ফিরে যায় বন্ধুত্বের চড় খেতে।

কে বন্ধু, কে ভালোবাসার মানুষ...। ছবি: সৈকত ভদ্র

একপর্যায় সে আর না পেরে মেয়েটিকে বলে ফেলে। সঙ্গে অনেক কান্নাকাটি, অনেক গোলাপ আর অসম্ভব কাঁচা হাতে লেখা একটি ১৪ লাইনের কবিতা। গোলগাল নিশ্চিত যে হয় সে চড়-থাপড় খাবে, না হলে তার আবেদন গ্রহণ হবে। ছলছল চোখে মেয়ে বলে, ‘আমাদের বন্ধুত্বকে এত ছোট করতে পারলে? আর কখনো এ রকম করবে না। সব সময় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকবে।’ হতভম্ব গোলগাল সব শক্তি হারিয়ে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে বন্ধুত্বের পানিপথে নেমে পড়ে। তারপর এক বছর বন্ধুত্বের চাকুতে ক্ষতবিক্ষত হয় সে। প্রেম যতই বাড়ে, বন্ধুত্ব ততই গভীর হয়। এর মধ্যে মেয়ে আরেকটি প্রেম করে। গোদের ওপর বিষফোড়ার ব্যথায়, গোলগালের ৫০ পাউন্ড ওজন কমে যায়।
তারপর সেকন্ড ইয়ারের মাঝখানে এক আচমকা ও অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। গোলগালের আরেকটা মেয়েকে পছন্দ হয়। নতুন প্রেমের বাস্তবায়নের কথা সে ভাবেই না। প্রায় দুই বছর পরে বন্ধুত্বের জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েই সে খুশি। লাফিয়ে লাফিয়ে যায় তার বন্ধুকে সুখবর দেওয়ার জন্য। এর পরের কথোপকথন—
গোলগাল: একটা সুখবর আছে!
মেয়ে: কী?
গোলগাল: আমার অমুককে ভালো লাগে
(পিনপতন নীরবতা)
গোলগাল: শুনছিস? আমার অমুককে ভালো লাগে!
(আরও গভীর নীরবতা)
গোলগাল: শুনছ... (ঠাশ ঠাশ ঠাশ তার গালে তিনটা চড়)
(আরও কিছুক্ষণ নীরবতা)
মেয়ে: আমার বন্ধুত্বকে এত ছোট করতে পারলে?
গোলগাল: আর হবে না।
মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। গোলগালের এখনো বিয়ে হয়নি। যদিও ওই মেয়ের কারণে নয়।