
নদের বুকে মানুষের ভিড়। হাঁটু বা কোমরসমান পানিতে নেমে মাছ ধরতে জাল ফেলছেন কেউ। আবার কেউ পলো দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন। জাল বা পলোতে আটকে পড়া মাছ নিয়ে কেউ কেউ খুশিতে মেতে ওঠেন। আর নদের পাড়ে ভিড় করে এ দৃশ্য দেখছেন উৎসুক মানুষ। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার মনু নদে এভাবেই গতকাল শনিবার জমে ওঠে ‘হাট বাওয়া’ উৎসব।
এলাকাবাসীর মতে, লোকজন জড়ো হয়ে একই সময়ে মাছ ধরার কারণে উৎসবটির এমন নামকরণ হয়েছে। শত বছরের বেশি সময় ধরে এ উৎসব চলে আসছে।
সরেজমিনে বেলা ১১টায় দেখা গেছে, উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কটারকোনা সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে গেছে মনু নদ। নদে পানি কমে গেছে। আর এরই মধ্যে চলছে ‘হাট বাওয়া’ উৎসব। লোকজনের সমাগম বেশি হওয়ায় অনেকে হুইসেল বাজিয়ে এক জালের কাছাকাছি অন্য জাল না ফেলতে সংকেত দেন। অনেকের জাল ও পলোতে আইড়, বোয়াল, ঘাঘট, রুই, কালবাউশ, সরপুঁটি, পাবদা, মলাসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা পড়ে।
মাছ ধরতে ব্যস্ত পার্শ্ববর্তী পৃথিমপাশা ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুর নূর (৫৫) বলেন, ‘ছোটবেলা থাকি হাট বাইয়ার। মাছ পাওয়া, না-পাওয়া বড় কথা নয়। এই যে সবাই মিলে মাছ ধরে, এইটাই তো বড় আনন্দ। এর পরেও দুইটা রুই, চাইরটা বোয়াল আর কিছু ছোট মাছ পাইছি।’
উসবের নামকরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাজীপুরের ভূঁইগাঁও গ্রামের আবদুস শহীদ (৫০) বলেন, ‘হক্কলে মিলি হাত লাগাইয়া মাছ ধরইন। হাটর মতো মানুষ জমে। এর লাগি এইটারে হাট বাওয়া বলা হয়। ১০০ বছরর বেশি সময় থাকি এইটা চলছে।’
এলাকাবাসী বলেন, পৌষ মাসের শুরুতে নদে পানি কমতে শুরু করে। এ সময় নদী তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামের লোকজন বৈঠক করে ‘হাট বাওয়ার’ দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন। নদের গভীর স্থানে (স্থানীয় ভাষায় ডহর) ‘হাট বাওয়া’ হয়। কটারকোনা সেতু এলাকায় একটি ও বেলেরতল এলাকায় দুটি এ রকম স্থান আছে। বেলেরতলে আজ রোববার (৩১ ডিসেম্বর) ও কাল সোমবার (১ জানুয়ারি) একইভাবে মাছ ধরা হবে।
উৎসব দেখতে আসা পৃথিমপাশা ইউনিয়নের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী ফয়জুল হক বলেন, ‘এই গাঙটা (মনু) শরীফপুর, পৃথিমপাশা, টিলাগাঁও ও হাজীপুর ইউনিয়নবাসীর দুঃখ বলেই সবাই জানে। দুই-তিন মাস আগেও পাহাড়ি ঢলে গাঙের বাঁধ ভেঙে চার ইউনিয়নে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে। অথচ এখন পানি কমায় গাঙে মাছ ধরতে এসে মানুষের খুশির শেষ নেই।’
হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল বাছিত বলেন, ‘আসলে হাট বাওয়াটা গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটা অংশ। এ উৎসবে কেউ শখে মাছ ধরেন। তবে দরিদ্র জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন মাছ ধরে স্থানীয় হাট-বাজারে তা বিক্রিও করেন। যাঁরা মাছ ধরতে পারেন না, তাঁরা বাজার থেকে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে নিয়ে যান। তবে ওই মাছের দাম অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি থাকে।’