Thank you for trying Sticky AMP!!

মাছের বৈচিত্র্যে আরও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

দেশে মাছের প্রজাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০৬। যদিও স্বাধীনতার পর পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। বিচ্ছিন্ন গবেষণায় নতুন কিছু মাছের প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

মাছে-ভাতে বাঙালি—এই প্রবাদই বাংলাদেশে মাছের প্রাচুর্যের কথা তুলে ধরতে যথেষ্ট। জাতিসংঘের হিসাবে, স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ গত বছর বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। তবে এরপরও অতৃপ্তি থেকে যায়। কারণ, মাছের প্রজাতির বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বেশ পেছনের দিকে।

তবে সেই অতৃপ্তিও কিছুটা কেটেছে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০ বছরে দেশে মাছের বৈচিত্র্যের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে স্বাদু ও সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা এখন এক হাজারের বেশি।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) সর্বশেষ হিসাব (২০১৯) বলছে, বাংলাদেশে মাছের মোট প্রজাতি রয়েছে ৫৬৯টি। এই হিসাবে মাছের প্রজাতির বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২২১টি রাষ্ট্র ও দ্বীপের মধ্যে ১০০তম। তবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের ডিন কাজী আহসান হাবীবের নেতৃত্বে একদল গবেষকের তৈরি করা হালনাগাদ তথ্য বলছে, দেশে শুধু সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি রয়েছে ৭৪০টি। এদিকে সরকারি হিসাবে দেশে স্বাদুপানির মাছের প্রজাতি ২৬৪টি। এই দুই হিসাব যোগ করলে বাংলাদেশে মাছের প্রজাতির সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০৬।

কাজী আহসান হাবীবের নেতৃত্বাধীন গবেষক দলটি হালনাগাদ ওই তালিকা তৈরি করেছে দেশে সামুদ্রিক মাছের বৈচিত্র্য নিয়ে বিগত ৫০ বছরে হওয়া জরিপগুলোর ভিত্তিতে। এ জন্য তাঁরা দেশি-বিদেশি সাময়িকীতে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ, সংশ্লিষ্ট বই ও গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মাৎস্যবিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী বাংলাদেশ জার্নাল অব ফিশারিজ সর্বশেষ সংখ্যায় নতুন এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মাৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংগঠন ফিশারিজ সোসাইটি অব বাংলাদেশ ১৯৭৮ সাল থেকে ষাণ্মাসিক এই সাময়িকী প্রকাশ করছে। এর সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর।

কাজী আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের জলসীমায় প্রতিবছরই কেউ না কেউ মাছের নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করছেন। আমরা ২০২০ সাল পর্যন্ত মাছের তালিকাগুলো যোগ করে এই হিসাব পেয়েছি। পূর্ণাঙ্গ জরিপ করলে হয়তো প্রজাতির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।’

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির হিসাবে, মাছের বৈচিত্র্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। ২ হাজার ৫৮৩টি প্রজাতি নিয়ে ভারতের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। বৈশ্বিক তালিকায় দেশটি ১১তম। ১ হাজার ১২৫টি প্রজাতি নিয়ে শ্রীলঙ্কা বৈশ্বিক তালিকায় ৩২তম অবস্থানে রয়েছে। আর ১ হাজার ১২২টি প্রজাতি নিয়ে মালদ্বীপ বিশ্বের ৩৩তম দেশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঁচ বছর ধরে পরিচালিত এক জরিপ প্রকাশিত হয়। এর ফলাফলে বলা হয়, এই ভূখণ্ডে সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৪৭৫। এরপর আর দেশে মাছের প্রজাতির কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং মৎস্য বিভাগের গবেষণায় নতুন নতুন মাছের প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু এসব তালিকা যাচাই-বাছাই করে কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান দেশের মাছের মোট প্রজাতির সংখ্যা নির্ধারণ করেনি।

মাছের প্রজাতি চিহ্নিত করা এবং মাছ উৎপাদন বাড়াতে কয়েকটি উদ্যোগের কথা জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগরের প্রজাতিগুলো চিহ্নিত করার কাজ শেষের দিকে। আমরা দেশি মাছের প্রজাতিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, সাগরেও কীভাবে খাঁচায় মাছ চাষ করা যায়, তা নিয়েও গবেষণা চলছে। সব মিলিয়ে দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদন আরও বাড়বে। আশা করা যায়, দেশের মানুষ সামনের দিনে আরও অনেক দেশি প্রজাতির মাছ খেতে পারবে।

বিশ্বে মাছের দুটি নতুন প্রজাতি

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগ যৌথভাবে দেশের সামুদ্রিক মাছের একটি তালিকা তৈরির কাজ করছে। সেটির ফলাফল চলতি মাসেই প্রকাশ করা হবে। যেসব মাছের প্রজাতি দেশের সমুদ্রসীমায় পাওয়া গেছে, তা থাকবে ওই তালিকায়।

এই হালনাগাদ তালিকায় অনেকগুলো মাছ আছে, যেগুলো দেশে প্রথমবারের মতো পাওয়া গেছে। গত ১০ বছরে এ ধরনের মাছের প্রজাতি পাওয়া গেছে প্রায় ৪০টি। এগুলোর মধ্যে বিশ্বে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত দুটি নতুন প্রজাতির মাছও রয়েছে, যার একটি সুন্দরবন এবং আরেকটি সেন্ট মার্টিনের প্রবাল অঞ্চল থেকে পাওয়া যায়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীবের নেতৃত্বে দুটি গবেষক দল এই দুটি প্রজাতি আবিষ্কার করে। একটি হচ্ছে বড় জালি পটকা, যার ইংরেজি নাম Bengal Reticulated Puffer। অপরটি পেট্টলি, যান ইংরেজি নাম Bengal demoiselle।

গবেষক দলটির নতুন ওই তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩০টি বর্গের ১৪৫টি গোত্র ও ৩৮৯ গণের মোট ৭৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৮১টি প্রজাতি তরুণাস্থিযুক্ত হাঙর ও রে-জাতীয় মাছ। বাকি ৬৫৯ প্রজাতি অস্থিযুক্ত মাছ।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার-২০২০ অনুযায়ী, ওই ৭৪০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫০ প্রজাতির মাছ বিপন্ন। এর মধ্যে ১০টি প্রজাতি মহাবিপন্ন, ১৪টি প্রজাতি সংকটাপন্ন ও ২৬টি প্রজাতি ঝুঁকিপূর্ণ। ওই ৭৪০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৩৯৫টি প্রজাতি সব সময় সামুদ্রিক লোনাপানিতে থাকে। বাকি ৩৪৫টি প্রজাতির মাছ উপকূলীয় ঈষৎ লোনা ও সামুদ্রিক লোনাপানি—উভয় জায়গায় পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে আবার ১২৪টি প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ স্বাদুপানির পরিবেশেও প্রবেশ করে।

বাংলাদেশের অনন্য দুটি উপকূলীয় ও সামুদ্রিক প্রতিবেশব্যবস্থা হচ্ছে সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিন। এর মধ্যে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে ও নিকটবর্তী সমুদ্র এলাকায় ২৭১টি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এগুলোর আবাসস্থল সামুদ্রিক লোনা ও আধা লোনাপানি। অন্যদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ২০৪টি প্রজাতির মাছ শনাক্ত করা হয়েছে, যারা প্রবাল প্রতিবেশে বসবাস করে।

সিংহভাগ মাছ আসে ১০ প্রজাতি থেকে

দেশে বছরে ৪৪ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। মাছের প্রজাতির সংখ্যা হাজারের বেশি হলেও এই ৪৪ লাখ টনের বেশির ভাগই আসে ১০টি প্রজাতি থেকে। এর মধ্যে রুই, কাতলা ও মৃগেল থেকে পাওয়া যায় ২০ শতাংশ মাছ। বিদেশি কার্পজাতীয় মাছ থেকে ১১ শতাংশ, পাঙাশ সাড়ে ১১ শতাংশ, তেলাপিয়া থেকে ৯ শতাংশ আসে।

প্রাকৃতিক উৎসের মাছগুলোর মধ্যে ইলিশ থেকে পাওয়া যায় মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ। চিংড়ি সাড়ে ৫ শতাংশের জোগান দেয়। পুকুরে চাষ হওয়া ৪৪ প্রজাতির দেশি মাছ থেকে পাওয়া যায় উৎপাদনের ৪ শতাংশ। ৮ শতাংশ মাছ আসে নদী-হাওর-বিল ও বঙ্গোপসাগরের মতো উন্মুক্ত জলাশয় থেকে।

বিগত এক দশকে দেশে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কিছু কিছু প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিক চাষের ফলে আবার সহজলভ্য হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশি ছোট মাছের প্রজাতিগুলোর চাষ পদ্ধতি নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করছি। সামনের দিনে বেশ কিছু জনপ্রিয় দেশি মাছ চাষের উপযোগী হবে বলে আশা করছি।’

বিলুপ্তির পথে অনেক প্রজাতি

কোনো একটি প্রজাতির মাছ ৫০ থেকে ১০০ বছর কোনো দেশে দেখা না গেলে তাঁকে ওই দেশের জন্য বিলুপ্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইইউসিএন, বাংলাদেশের ২০১৫ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে স্বাদুপানির প্রজাতির মধ্যে মোট ২৫৩ প্রজাতির মাছ লাল তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ এসব প্রজাতির মাছ কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন অবস্থায় আছে। এগুলোর মধ্যে হুমকির মুখে ২৫টি, ৩০টি বিপন্ন ও ৯টি অতি বিপন্ন অবস্থায় আছে। অতি বিপন্ন অবস্থায় থাকা বেশ কয়েকটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে রানী, বেতাঙ্গি, ঘোড়া মাছ, চিপ চেলা, গোফি চেলা, বাওবাইম ও বেতি বা পুতুল মাছ। মহাবিপন্ন প্রজাতিগুলো হচ্ছে খোরকা, ভাঙ্গন, নান্দিনা, মহাশোল, পিপলা শোল, কালা পাবদা, বাঘা আইড়, চেনুয়া ও একধরনের গুতুম মাছ। এসব মাছের প্রজাতিগুলোর বেশির ভাগই সুস্বাদু। তাই বেশি পরিমাণে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া এসব মাছের বসতি এলাকা নদী, হাওর, বাঁওড়, বিলগুলো দূষিত হয়ে যাওয়ায় তারা আর সেখানে টিকতে পারছে না। বিশেষ করে পদ্মা, কপোতাক্ষ, মধুমতী, হাকালুকি হাওর ও বাইক্কার বিল থেকে সবচেয়ে বেশি মাছের প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায় আছে।

হাওর ও বিলগুলো শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়, তখন সেখানে নানা ধরনের ফসলের চাষ হয়। আর এসব ফসলে ব্যবহৃত হওয়া কীটনাশকের কারণে অনেক মাছের পরে সেখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। পদ্মাসহ অন্যান্য নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় অনেক মাছ সেখান থেকে চলে গেছে। এর মধ্যে মহাশোল মাছ ঝর্নার প্রবহমান পানিতে ডিম পাড়ে। দেশের বেশির ভাগ এলাকা থেকে ঝর্না শুকিয়ে যাওয়ায় এই মাছ আর ডিম পাড়তে পারছে না। ফলে এ মাছ বিলুপ্তির পথে রয়েছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, দেশের একেকটি প্রজাতির মাছ মানে নিত্যনতুন প্রাণী বা খাদ্যতালিকার নতুন উপাদান নয়। প্রতিটি মাছ একেকটি জিনগত সম্পদ। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় তারা একেকটি জলাশয়ে বসবাস করে। ফলে মাছের প্রজাতি রক্ষা করতে তাদের বসবাসের জলাশয়কে সুরক্ষা দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, মৎস্যসম্পদের বৈচিত্র্য জানতে জরিপ হওয়া উচিত। এতে জানা যাবে, কোন ধরনের মাছ এখানে বেশি আছে, কোন প্রজাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কোন প্রজাতির মাছ আহরণ করা যাবে, কোনটা করা যাবে না, তা–ও নির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে।