মিনুর সংসার

বাংলাদেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে মা-বাবা সন্তানের জন্য সব করেন। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে মা-বাবা সন্তানের জন্য সব করেন। ছবি: সংগৃহীত

মিনুর শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। এর ওপর গতকাল রাতে ঘুমুতে যেতে একটু দেরিই হয়ে গেল। উপায় অবশ্য ছিল, তাও না। ছেলেটাকে টিফিনে কী দেবেন, সে চিন্তায় প্রতিদিন রাতে তাকে তটস্থ থাকতে হয়! পছন্দের টিফিন না হলে যেমন খাবার বাবু তেমনি রেখে দেবে। বাচ্চাটা অতটা সময় না খেয়ে থাকে, ভাবলে তার ছটফট লাগে।

গতকাল রাতে নিজের আবিষ্কার করা একটা রেসিপি রান্নার চেষ্টা করল মিনু। লেবুর রস, ধনেপাতা, আদা কুচি, জিরা-রাসুন বাটা, আর চটকানো আমলকী সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সে পানিতে মেখে মুরগির মাংস ৪ ঘণ্টা মেরিনেট করে রাখল। তারপর ভাপা পিঠার পাতিলের মুখে ঢাকনা দিয়ে ভাপে আরও ঘণ্টাখানেক। এবার সেটাকে নামিয়ে অল্প ঘিয়ে লাল লাল করে ভাজা। মিনু বুঝতে পারছে না চিকেনের স্বাদটা কেমন হবে, তবে ছেলে যে খাবে, সেটা সে নিশ্চিত। অবশ্য এমনিতেও রাতে সব গুছিয়ে ঘুমুতে যেতে দুইটা-তিনটা বেজে যায়। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগলেও এখন এটাই মানিয়ে নিয়েছে মিনু। ওর মা বলে, যেদিন মেয়ে হয়ে মিনু জন্ম নিয়েছিল, সেদিনই তার কপালে সবকিছু, সব মানিয়ে নেওয়ার কথা লেখা হয়ে গিয়েছিল।

এদিকে মেয়েটার ঘুমের সাইকেল এখনো ঠিক হয়ে আসেনি। কখনো সারা রাত, তো কখনো সারা দিন ঘুমায়। তিমুর ছেলেমানুষি স্বভাব এখনো যেন যায়নি, মেয়ের নাম আগেই ঠিক করে রেখেছিল—অগ্নিলা মারিয়াম। যেভাবে ছেলের নামের ক্ষেত্রে কাউকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি, মেয়ের ক্ষেত্রেও বাপের ইচ্ছেই নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পেল। বাপ আবার মীর্জা গালিবের অন্ধভক্ত। মিনুর পছন্দ না হলেও মীর্জা লাগিয়েই ছেলের নাম রাখা হয়েছিল, মির্জা য়িযনি আনহার। দাদা-নানা সবাই বলেন, ওই কঠিন নাম উচ্চারণ করা সম্ভব না, তাই ছেলের নাম বাবু ডাকতে ডাকতে বাবু হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হলো।

সাত মাসের বাচ্চা অথচ বাপকে চেনে একেবারে পাগলের মতো। মিনু ছেলে-মেয়ে দুজনের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটতে দেখছে। তাতে অবশ্য তার খারাপ লাগে না। রাত আটটার পর বাবু, অগ্নিলা দুজনে যেন ছটফট করে বাবাকে খুঁজতে থাকে। সাধারণত সেই সময়টাতেই তিমু অফিস থেকে ফেরে। প্রতিদিন যে পারে, তা নয়। রাস্তায় একটু জ্যাম হলে কোনো কোনো দিন ১১-১২টাও বেজে যায়। বাজবেই বা না কেন, কোথায় দিল্লি আর কোথায় কলকাতা। মতিঝিল থেকে ৬টায় পাবলিক বাসে উঠলে উত্তরা পৌঁছাতে এমনিতেই সময় লাগার কথা। তিমুকে ওর মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব অনেকে ওদিকে বাসা নিতে বললেও তিমুর কথা একটাই, ভালো কিছু চাইলে পরিবারের কাউকে না কাউকে তো ছাড় দিতেই হয়, সেটা অবশ্যই বাবার পক্ষ থেকে হওয়া উচিত। ছেলের জন্মের আগেই বাপের স্বপ্ন তিমু তাকে রাজউক মডেল স্কুলে পড়াবে। সে সময় বেশ কয়েক বছর পরপর এত ভালো রেজাল্ট করল স্কুলটি, সে থেকেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। মিনু বোঝে অফিসে যেতে-আসতে প্রতিদিন ৫-৬ ঘণ্টা বাসে বসে থাকাটা চাট্টিখানি কথা নয়, তিমুর এখন আগের সেই প্রাণোচ্ছ্বাসটাও নেই। বাসে, কখনো উবার বাইকে—এত দীর্ঘ যাতায়াত করতে করতে তার কোমরের ব্যথাটাও অসহনীয় পর্যায়ে বেড়ে চলছে।

অথচ কত শখ করে, কতভাবে জমিয়ে গাড়িটা কিনেছিল। একদিন বাবুই বলল, স্কুল থেকে আসার পথে একটা গাড়ি তাদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়েছে। ব্যস, মিনু আর কোনো দিন তিমুকে গাড়ি নিতে দেখল না। বাবুর স্কুলে যাওয়া-আসা করার জন্য গাড়িটা তো ছাড়লই, ড্রাইভারের খরচের একটা অতিরিক্ত খাতও স্থায়ী হলো।

কারও ঘুম ভাঙুক বা না ভাঙুক, মিনুকে প্রতিদিন ভোরের আলো ওঠার আগেই উঠতে হয়। নাশতা তৈরি করা, তিমুর দুপুরের খাবার, বাবুই-এর বই-ব্যাগ, টিফিন তৈরি করা, গত রাতের বাসি থালাবাসন ধোয়া-মোছা, বাসি ঘরগুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করা, আরও কত টুকিটাকি কাজ। বুয়ার অপেক্ষায় থাকলে সে কাজ আর সেদিন হয় না, এটা মিনুর জীবন থেকে শেখা অভিজ্ঞতা। তার মধ্যে অগ্নিলার অভ্যাসটা দিন দিন এমন হয়ে উঠছে, মায়ের ওমে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ নিশ্চিত ঘুম, যেমনি সে উঠে গেল, মেয়েটা চিৎকার আর কান্না জুড়ে দেয়। তিমু বেশ কবার মেয়েকে চেষ্টা করেছে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুতে। কোনো লাভ হয়নি। ওর চিৎকারে বাবুইয়েরও কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যায়। তিমু বলে, সামনে ছেলেটার বৃত্তি পরীক্ষা, এখন নির্বিঘ্ন ঘুম তার খুব প্রয়োজন। তা ছাড়াও মেয়েটা কান্না শুরু করলে মিনু হাতের কাজগুলো আর করতে পারে না। ভীষণ মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় সবকিছু। তিমু ভেবেই পায় না কী করবে!

একদিন হাস্যকর একটা সমাধান বের করল সে। মিনুকে ফিসফিস করে বলল, তোমার একটা বড়সড় ব্রা বা বক্ষবন্ধনী আর কিছু তুলা দাও। মিনু চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ইংল্যান্ড থেকে আনা খালাত বোনের কাছে উপহার পাওয়া বেঢপ সাইজের অব্যবহৃত ব্রাটা তিমুর হাতে দিল। বাবুই ঘুমিয়ে পড়তে তিমু সেটির ভিতরে তুলাভরে নিজের বুকে পরে নিয়ে তার ওপর মিনুর একটা ঢিলেঢালা টিশার্ট পরে নিল। এরপর অগ্নিলাকে বুকে জড়িয়ে ঘুম, ম্যাজিকের মতো কাজ হলো, অগ্নিলা মায়ের বুকে আছে ভেবে হঠাৎ হঠাৎ আর ঘুম থেকে জেগে ওঠে না।

৫ বছর পর.…..
আল্লাহর রহমতে বাবুর রেজাল্ট খুবই ভালো। সব সময় ক্লাসে ফার্স্ট। ক্লাস ফাইভে, এইটে—দুই ক্লাসেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল। ছেলেকে নিয়ে মা-বাবার গর্ব আর স্বপ্নের শেষ নেই। তিমু সংসারের সচ্ছলতা, ছেলের সর্বোচ্চ ভালো মানের পড়াশোনা আর স্ট্যান্ডার্ড ঠিক রাখতে অফিস শেষে আরও দুঘণ্টা ওভারটাইম শুরু করল।

৩ বছর পর...
দেখতে দেখতে টেস্ট পরীক্ষা হলো, এসএসসি শেষ হলো। রেজাল্ট কয়েক মাস বাকি। বাবুই মার কাছে বায়না ধরল, বন্ধুরা মিলে সাত দিনের জন্য সুন্দরবনে বেড়াতে যাবে। মিনুর কথা একটাই, বাবা পারমিশন দিলে যাবে। বাপের কাছে কথাটা পারতেই তিমুর বুক ধক করে উঠল। এও ভাবল, এত বড় হয়েছে ছেলেটা, অথচ ওর মা কখনো এক রাতের জন্য ছেলেকে ঘরের বাইরে ছাড়েনি। তিমু বুঝতে পারছে, ওর মায়ের ভীষণ কষ্ট হবে ছেলেকে ছেড়ে থাকতে, তবু ছেলের স্বাবলম্বী হওয়া উচিত ভেবেই বাবুইকে অনুমতি দেওয়া হলো।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে মা-বাবা সন্তানের জন্য সব করেন। ছবি: সংগৃহীত

ছেলেরা ব্যাগট্যাগ নিয়ে হই হুল্লোড়ে খুলনার বাসের উদ্দেশে রওনা করল৷ অন্য কারও বাবা বাসস্ট্যান্ডে ছেলেকে বিদায় দিতে না এলেও মিনুকে সঙ্গে যেতে হলো। বাস ছাড়া পর্যন্ত ছেলেকে চোখছাড়া করল না। তিমু ছেলের কাছে বিদায় নিয়ে দূরে চোখের আড়ালে এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যে, সে তাদের দেখতে পেলেও তাদের চোখের সীমানায় থাকল না তিমু।

মাকে ছেলে বারবার বলার পরে তো আসেইনি, বরং আশ্চর্যজনকভাবে তিমুও ছেলেদের বাসটি না ছাড়া পর্যন্ত এক সেকেন্ডের জন্যও বাবুইকে আঁখিহারা করল না। এমনকি সিগারেটের চরম নেশা উঠলেও না। আরও আশ্চর্যজনক হলো, বাস ছাড়ার পর বাবুইর মায়ের মতো তিমুর চোখ বেয়েও জল বাইতে শুরু করল। দুজনই বাসের মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত থম ধরে জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

এক দিনের জন্য যে ছেলেকে চোখের আড়াল করেনি, সাত দিন তাদের জন্য একটু বেশি দীর্ঘ, দীর্ঘতর ও দীর্ঘতম হয়ে উঠল। বাবুইয়ের কথা তিমু বা তার মায়ের মনে পড়লে দুজনেই আলাদা করে গোপনে বুক ছিঁড়ে অস্তিত্ব বেরিয়ে আসা ব্যথা অনুভব করতে থাকল। এবং তা পুরো সাত দিন প্রতি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিটে।

তারপর ৭ বছর পর...
বাবুই সব দুর্দান্ত রেজাল্ট করতে করতে অনার্স-মাস্টার্স পাস করে ফেলল। মিনুর চেহারায় এখন স্পষ্ট বয়সের ছাপ। তিমুর কোমরব্যথার প্রকোপ এত বেশি যে বেশির ভাগ সময় শুয়ে-বসে থাকতে হয়। অফিসে যাওয়া দূরে রইল, সে এক মিনিটের জন্য বাইরে একা যেতে পারে না। অগ্নিলা বিয়ের পর চট্টগ্রামে তার স্বামীর সঙ্গে সেখানেই স্থায়ী। প্রতিদিন ফোন করে মা-বাবার খোঁজ নেয়।

একদিন বাবুই দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। জানাল মোনাস ইউনিভার্সিটিতে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য যে আবেদন করেছিল, তারা তা একসেপ্ট করেছে এবং সামনের মাসের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়াতে যেতে বলেছে।

কয়েক দিন পর বাবুই অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে প্লেনে চেপে বসল। সেদিনও মিনু ও তিমু দুজনই এয়ারপোর্টে এসে ছেলেকে বিদায় দিল.....

এবং
আরও ৪ বছর পর...

বাকি অংশটি আপনি এবং ওনার জন্যই না হয় থাক তোলা। আপনারা যেভাবে চাইবেন, গল্পের শেষ সেখানেই ....।

*মেহেদী হাসান তামিম