১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সারা বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ঢাকার মিরপুর ছিল ব্যতিক্রম। বিহারি, রাজাকার ও কিছু পাকিস্তানি সেনা পুরো এলাকা দেড় মাস অবরোধ করে রাখে। সেনাবাহিনীর অভিযানে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি দখলমুক্ত হয় মিরপুর। ’৭১-এর ৫ মার্চ থেকে অভিযানের আগ পর্যন্ত ওই এলাকায় বাঙালিরা প্রবেশ করলেই হত্যা করা হতো। ফলে পুরো মিরপুর অঞ্চল হয়ে যায় বিশাল একটি বধ্যভূমি। তবে দু-একটি ছাড়া এই বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত মিরপুরের ১০ বধ্যভূমি বইয়ে ১০টি প্রধান বধ্যভূমির বর্ণনা রয়েছে। এগুলো হলো মিরপুরের কালাপানি, রাইনখোলা, শিরনিরটেক, সারেং বাড়ি, গোলারটেক, বাংলা কলেজের আমবাগান, আলোকদি, মুসলিম বাজার, শিয়ালবাড়ি ও জল্লাদখানা। এর মধ্যে জল্লাদখানা বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এখানে একটি স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করেছে।
রাইনখোলা বধ্যভূমিতে পাঁচ ফুট উচ্চতার ছোট একটি ত্রিভুজ আকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছেন এই এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি। কিন্তু রাইনখোলা বধ্যভূমিতে বিয়ে, সুন্নতে খতনা, জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভে কেউ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন না।
১৯৯৩ সালে রাইনখোলা বধ্যভূমির জায়গাটি ছিল ডোবা। সে সময় পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ করার সময় রিজার্ভারের ভেতর থেকে পাওয়া যায় চার শ থেকে পাঁচ শ মানুষের মাথার খুলি ও প্রচুর হাড়গোড়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে পয়োনিষ্কাশনের এই রিজার্ভারে ফেলে দেওয়া হতো। এই সরকারি খাসজমিটি দখলের চেষ্টা করেছিল প্রভাবশালী একটি চক্র।
মিরপুরের মুসলিম বাজার বধ্যভূমির কথা জানা যায় ১৯৯৯ সালে ২৭ জুলাই। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে নূরী মসজিদ (বর্তমানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামে মসজিদ কমপ্লেক্স) সম্প্রসারণের সময় একটি পরিত্যক্ত কূপ থেকে তিনটি মাথার খুলি ও বেশ কিছু হাড়গোড় পাওয়া যায়। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ওই কূপ খনন করে বহু মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। দেহাবশেষ উদ্ধারের পর মসজিদের নামকরণ হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামে মসজিদ কমপ্লেক্স। তবে নামকরণ করা হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও মিরপুর মুক্ত করার অভিযান-সম্পর্কিত কোনো তথ্য বা সেই সময় হত্যাকাণ্ডের কোনো তথ্য মসজিদ বা এর আশপাশে কোথাও লেখা নেই। শহীদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে মসজিদের ভেতর একটি কালো রঙের পিলার নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের কোষাধ্যক্ষ মতিউর রহমান।
এ ছাড়া বাকি বধ্যভূমির স্মৃতিচিহ্ন অনেকটাই মুছে যাওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। বাড়িঘর, দোকানপাট, সড়ক গড়ে উঠেছে এখানে। সরকারিভাবে এই বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি।
স্বাধীনতার পর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে শিয়ালবাড়ি এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়। লাশগুলো সংরক্ষণ করে বর্তমানে গণকবর নামে পরিচিত একটি স্থানে একসঙ্গে গণকবর দেওয়া হয়। এই গণকবরের অনেক জায়গায় এখন বহুতল ভবন ও মার্কেট গড়ে উঠেছে।
বাংলা কলেজের সম্মান ভবন, টিচার্স কমন রুমের পাম্প হাউসের কূপ ও পুরোনো আমগাছের গোড়ায় জবাই করা হতো বাঙালিদের। কিন্তু সেখানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি।
বধ্যভূমিগুলোর স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বধ্যভূমি চিহ্নিত করতে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় সারা দেশের সাড়ে তিন হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বধ্যভূমির সেই তালিকাই আর পাওয়া যায়নি।