গতকাল রাত নয়টায় চিরতরে নীরব হয়ে গেলেন অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। রাজশাহীর পদ্মাপারে নিজের বাড়িতেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বহুদিন ধরেই তাঁর শরীর ভেঙে আসছিল। গত আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি হন শঙ্কা জাগিয়ে। ফেরেন আরও ভগ্ন শরীর নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের ভাবুক শিবনারায়ণ রায়ের আহ্বানে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াতে গিয়ে দ্রুত ফিরে এসেছিলেন দেশে। দেশ ছিল তাঁর জীবনের কেন্দ্রে, তাঁর সাহিত্যও।

লিখি, কারণ এ ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানি না। অধিকাংশ লেখকই ‘কেন লেখেন’ এমন প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, লিখে তিনি ঋণ শোধ করেন। সমাজের কাছে, মানুষের কাছে। ‘বেঁচে থাকার উপকরণ জোগাচ্ছে সমাজ। কেবলই নিতে থাকলে যে লজ্জা ও অপরাধবোধ জমা হতে থাকে, তা থেকেই লিখি,’ তিনি বলেছিলেন।
৮২ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে হাসান আজিজুল হক আমৃত্যু তাঁর সে ঋণ শোধ করে গেছেন, এ কথা বলায় কোনো চালাকি নেই। লেখালেখিই তাঁর মাধ্যম, কারণ নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, লেখাই হচ্ছে তাঁর সাধ্যায়ত্ত শ্রেষ্ঠ কাজ। লেখার ভেতর দিয়ে তিনি যাপিত ও উপলব্ধ জীবনের চালচিত্র কঠোর ও আপসহীন শর্তে লিখে গেছেন। তিনি একে আয়নার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, কোনো অহংকার বা অর্জন অর্থে নয়, শ্রমিকের মজুরি হিসেবে। সেই তিনি নিজেকে প্রকাশের আর কোনো প্রয়োজন বোধ করবেন না। আমরা যারা রয়ে গেলাম তাঁর প্রস্থানের শূন্যতার মুখোমুখি হতে, তাদের জন্য তাঁর সাহিত্যকর্মে রয়ে গেল সেই আয়নাটি।
প্রায় কৈশোরে, যখন নির্দোষ বিনোদনের বাইরে সাহিত্যের মূল্য আমার কাছে অজ্ঞাত, সে সময় প্রথম আবিষ্কার করি হাসান আজিজুল হককে। কলেজের প্রথম বর্ষে হাতে আসে অতি কৃশকায় একটি গল্পগ্রন্থ, আত্মজা ও একটি করবী গাছ। সব মিলিয়ে মোট আটটি গল্পের সংকলন। নিঃস্ব, অভাবী ও একাকী কিছু মানুষের গল্প। তাঁরা সবাই আমাদের আশপাশের, অথচ অধিকাংশই আমাদের অপরিচিত। অনেকেই জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত, অথচ বাঁচার জন্য, স্বপ্ন দেখার জন্য কী অফুরান চেষ্টা। এই বই পড়েই জেনেছিলাম, মানুষের পরাজয় হয়, কিন্তু মানবের স্বপ্নের পরাজয় হয় না।
মনে আছে, গল্পগ্রন্থটি পাঠ শেষে আমি হাসান আজিজুল হককে তাঁর রাজশাহীর ঠিকানায় একটি চিঠি লিখেছিলাম। সে সময় পূর্বপত্র নামে আবাল্য বন্ধু আফসান চৌধুরী ও আমি যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ পত্রিকা সম্পাদনা করি। সে পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের জন্য গোটা কয়েক প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম, জানার চেয়ে জানানোর ইচ্ছাই সেখানে প্রকট ছিল। জবাব পাব, এমন আশা ছিল না। অথচ সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দীর্ঘ এক চিঠি এসে হাজির, প্রতিটি প্রশ্ন গুরুত্ব নিয়ে জবাব দিয়েছেন তিনি। পরে শুনেছি, কৌতুকমিশ্রিত আগ্রহে জানতে চেয়েছিলেন পত্রলেখকের বয়স কত।
সেই চিঠি তাঁর ও আমার মধ্যে একটি সেতু তৈরি করে দিয়েছিল। বয়স ও বোধের ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে নিকট-সম্পর্ক জন্মেছিল। আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে, স্থানগত এই দূরত্ব সেই নৈকট্যে চিড় ধরাতে পারেনি। হাসান আজিজুল হক—পরে তাঁকে হাসান ভাই নামে সম্বোধন করতাম—বার কয়েক নিউইয়র্কে এসেছেন। আমিও দেশে বেড়াতে এলে সবান্ধব রাজশাহী তাঁর বাসায় ঘুরে এসেছি। তাঁকে একবার ব্রুকলিনের কোনি আইল্যান্ডে আটলান্টিক সমুদ্রপারে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে রাজশাহীতে বেড়াতে এলে তিনি আমাকে পদ্মা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পদ্মা তখন প্রমত্ত। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে হেসে বলেছিলেন, নিজেই বলো, কার জিত।
হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, লেখক হিসেবে নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সচেতন। লেখক তো কেবল গল্প বলেন না, তিনি পাঠককে তাঁর পরিপার্শ্ব বিষয়ে সচেতন করে তোলেন। হাসান আজিজুল হক আজীবন পাঠককে তাঁর পরিপার্শ্বের নির্মম ও মোহহীন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এর লক্ষ্য একটাই, তা হলো সে বাস্তবতাকে বদলে দেওয়ার কাজে অনুপ্রাণিত করা।
তাঁর প্রথম দিকের গল্পের মানবজমিন এমন দুঃসহ ও কঠোর যে পাঠক হিসেবে কখনো কখনো আপত্তি জন্মে। সে আপত্তির কথা জানাতে তিনি বলেছিলেন, পাঠককে কাঁদানো তাঁর লক্ষ্য নয়। তাঁর গল্পের চরিত্ররা কাঁদে বটে, কিন্তু তাদের চোখের জলের স্বাদ তেতো অথবা কষা। অন্য কথায়, কান্না নয়, তাঁর আসলে লক্ষ্য শ্লেষ ও বিদ্রূপ, বাস্তবের বিকল্পতা নির্মাণে শক্তিমান লেখকের রয়েছে যে দুই হাতিয়ার। উদাহরণ হিসেবে আমরা ভাবতে পারি আত্মজা ও করবী গাছ গল্পের অসহায় অক্ষম পিতার কথা, আত্মজার অবমাননা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে যে আত্মহননের কথা ভাবে, ‘আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ বৃদ্ধের সে কথা চাবুকের মতো এসে লাগে।
অথবা ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পে জমি চাষের একমাত্র বলদ হারানোর পর দরিদ্র কৃষক করমালির স্ত্রীর প্রস্তাব, ‘আমারে দিয়ে হয় না? আমি
দেহিছি দামড়া না থাকলি দুধের গাই দিয়ে আবাদ করিছো জমি। এহন আমারে দিয়ে পারবা না?’ নির্বিকার এমন হাহাকার আর কারও লেখায় পড়েছি মনে হয় না।
অসত্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে লেখা তাঁর কোনো কোনো গল্পে এই কঠিন, কঠোর বাস্তবতা আমাদের খাবলে ধরে। মনে হয় তিনি বড় অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন, দ্রুত সব বদলে যাবে, এমন আশা করছেন। যেমন ‘ঘর গেরস্তি’ গল্পে গৃহহীন রামশরণের উক্তি, ‘স্বাধীন হইছি না কি হইছি আমি বোঝবো কেমন করে? আগে ভিটে ছিল—এখন তাও নেই। আমি স্বাধীনটা কিসি?’ অথবা ‘কেউ আসেনি গল্পে’ আসফ আলীর প্রশ্ন, ‘কই, কেউ তো আমারে কলো না যে দ্যাশ স্বাধীন হইছে। কেউ তো কলো না এখন কি হবে?’
পরে, সম্ভবত বেশ অনেকটাই পরে, হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, এমন বিদ্রূপ, এমন আশাহীনতা ঠিক হয়নি। অন্যত্র, ‘জীবনের জঙ্গমতা: লেখকের দায়’ প্রবন্ধে নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বড় ঘটনার ফলে আমাদের মূল্যবোধের যে আমূল পরিবর্তন তিনি আশা করেছিলেন, বাস্তবে তা ঘটেনি। জনজীবনে গুরুতর তেমন পরিবর্তন দেখা দেয়নি। সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থন করেই লিখেছিলেন, মানুষই যেহেতু লেখকের প্রধান ও প্রায় একমাত্র আগ্রহের বিষয়, সে জন্যই সব বাগাড়ম্বর ভেদ করে লেখকদের বারবার বাংলাদেশের মানুষের নিদারুণ বঞ্চনার গল্পই ঘুরেফিরে শোনাতে হয়েছে।
কোনো রকম বাগাড়ম্বর ছাড়াই তিনি নিজে যে আমাদের সেই গল্পই আমৃত্যু শুনিয়ে গেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের প্রতিটি প্রধান সংকটময় মুহূর্তে আমরা তাঁকে কাছে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর অবস্থান ছিল আপসহীন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনে তাগাদা দিয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও গ্রহণ করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। রাজধানী ঢাকার বদলে রাজশাহীতে কর্মজীবন বেছে নেওয়ায় তিনি হয়তো ‘মিডিয়ার তারকা’ হয়ে ওঠেননি, তা হতেও চাননি। কিন্তু তিনি যখনই কোনো বিষয়ে কথা বলেছেন, সে কথা বিবেকের সম্মিলিত উচ্চারণ হিসেবেই আমরা গ্রহণ করেছি।
মৃত্যু তাঁকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেও তিনি রেখে গেছেন বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের নিরন্তর সংগ্রামের বিবরণ। এই যে ‘বিশাল জীবন্ত অনিশ্চিত মহাবাস্তব,’ আসন্ন সময়ে পথ চলতে আমাদের তা আলো জোগাবে।
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাসান আজিজুল হক তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সৃজনশীলতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।