ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতির মামলা

রাগীব আলী ও তাঁর ছেলের ১৪ বছরের কারাদণ্ড

তারাপুর চা-বাগানের জমি আত্মসাতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলায় শিল্পপতি রাগীব আলী ও তাঁর ছেলে আবদুল হাইকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেটের মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম মো. সাইফুজ্জামান হিরো এ রায় দেন।
কারাদণ্ড ছাড়াও রাগীব আলী ও তাঁর ছেলেকে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয় বলে জানান সিলেট মহানগর আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মাহফুজুর রহমান।
সিলেটের দেবোত্তর সম্পত্তি ‘তারাপুর চা-বাগান’ অবৈধভাবে দখলের অভিযোগে করা দুই মামলার মধ্যে এটি একটি।
এ মামলার রায়কে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ রায় অভিহিত করে আদেশে বলা হয়, রাগীব আলী ও তাঁর ছেলে আবদুল হাই শুধু সিলেট নয়, দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্তমানে বাংলাদেশে তাঁদের অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি জালিয়াতি করে মানবিক মুখোশ পরে জনসম্পদ আত্মসাৎ করছেন, তার এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ঘটনাটি।
রায়ের দিন ধার্য থাকায় গতকাল আদালতপাড়ায় অতিরিক্ত পুলিশ পাহারা ছিল। ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়। রাগীব আলী ও আবদুল হাইকে আদালতে হাজির করা হয়। বেলা তিনটার দিকে আদালত সংক্ষিপ্তভাবে রায় পড়ে শোনান। এ সময় আইনজীবীরা দণ্ড ও ধারাগুলো আবার পাঠ করার আবেদন করলে বিচারক দ্বিতীয়বার পড়ে শোনান।
সরকারি কৌঁসুলির দপ্তর সূত্র বলেছে, মামলায় ১৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাগীব আলীর পক্ষে তাঁর মালিকানাধীন চা-বাগানের দুজন ব্যবস্থাপক সাক্ষ্য দিয়েছেন।
৪২২ দশমিক ৯৬ একর জায়গায় গড়ে ওঠা হাজার কোটি টাকার তারাপুর চা-বাগানের জমি আত্মসাতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জাল করার অভিযোগ আনা হয় রাগীব আলী ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে। ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে চা-বাগানটি নিয়ে আলোচনার পর এ মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম আবদুল কাদের ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতি ও সরকারের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে দীর্ঘদিন মামলা দুটির কার্যক্রম স্থগিত থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। তবে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মামলা পুনরুজ্জীবিত করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
পরে ২২ মার্চ মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মফুর আলীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শেষে ১০ জুলাই অভিযোগপত্র দাখিল করে। আদালত ১২ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে সেদিন বিকেলে সিলেটের জকিগঞ্জ ইমিগ্রেশন হয়ে পালিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে চলে যান ছেলেসহ রাগীব আলী। ২৩ নভেম্বর ভারতের করিমগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে রাগীব আলী ও এর আগে ১২ নভেম্বর ভারত থেকে জকিগঞ্জ এসে গ্রেপ্তার হন আবদুল হাই।
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সিলেটের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মিসবাহউদ্দিন সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোক না কেন, কেউ-ই যে আইন ও বিচারের ঊর্ধ্বে নন, বিষয়টি আবার এই রায়ে প্রমাণিত হলো।’
তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পংকজ কুমার গুপ্ত সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘জালিয়াতির মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া গেছে। আশা করি, আত্মসাতের মামলাতেও ন্যায়বিচার পাব।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রায়ের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে আসামিপক্ষের এক আইনজীবী বলেন, রাগীব আলী উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা বলেছেন।
অপর মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ
ছেলেমেয়েসহ রাগীব আলীর বিরুদ্ধে এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা অপর মামলায় গতকালও সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। জালিয়াতি মামলার রায় ঘোষণার আগে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। এ মামলার আসামি রাগীব আলীর মেয়ে রোজিনা কাদির ও তাঁর স্বামী আবদুল কাদির পলাতক রয়েছেন।
ব্যাংক, চা-বাগান, শিক্ষা, চিকিৎসা, সংবাদপত্র শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৭৮ বছর বয়সী বিতর্কিত ব্যবসায়ী রাগীব আলীর।