সরকারি-বেসরকারি খাতে নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু শিক্ষকের পদ বাড়েনি। ৬৩ শতাংশ পদ শূন্য রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে লেখাপড়া। প্রতিবছর শুধু সরকারি খাতে নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট থেকে তিন হাজার নার্স পাস করে বেরোলেও তাঁদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
২০০৯ সালের ১২ জুলাই ‘বেসরকারি পর্যায়ে নার্সিং কলেজ/নার্সিং প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও নার্সিং কোর্স চালুকরণ-সংক্রান্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন করে সরকার। ওই নীতিমালায় সার্বক্ষণিক বিষয়ভিত্তিক নার্স শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আছে। নার্সিং কাউন্সিল ও সেবা পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, নীতিমালার প্রয়োগ সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই নেই।
দেশের অন্তত ১০টি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রতিষ্ঠান চালাতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। শিক্ষক চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিতে দিতে তাঁরা ক্লান্ত। সংকট কাটাতে তাঁরা নির্ভর করছেন অতিথি শিক্ষক আর হাসপাতালের নার্সদের ওপর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক শহিদুল হক মল্লিক বলেছেন, রোগীর শারীরিক অবস্থা কেমন, সে সম্পর্কে চিকিৎসককে জানানোর দায়িত্ব নার্সদের। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির প্রভাব বেশ ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে। ওয়ার্ডে তাঁদের যে তৎপরতা, তা অনেক সময়ই হতাশাজনক।
দেশে এখন ১২৩টি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট। সরকারি খাতের ৫৩টি প্রতিষ্ঠানে ৩৬৬টি পদের ২৩২টিই শূন্য। বাংলাদেশের নার্সিং শিক্ষা চলছে ১৯৭৭ সালের নীতিমালার ওপর। এ সময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, পাঠ্যক্রম হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। কিন্তু নীতিমালায় সংশোধন এনে শিক্ষকের পদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নার্সদের উচ্চতর লেখাপড়ারও কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি।
সেবা পরিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিলোফার ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, সমস্যা চিহ্নিত। নতুন নিয়োগবিধি কার্যকর হলে সমস্যার সমাধান হবে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়োগবিধি মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব মো. আসাদুজ্জামান এই অবস্থার জন্য সরকারের দূরদর্শিতার অভাব এবং নার্স নেতাদের অনৈক্যকে দায়ী করেছেন।
>কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। শিক্ষকের ৬৩ শতাংশ পদ শূন্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেবা খাতে এখন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০১ জন নার্স প্রয়োজন। একজন চিকিৎসকের বিপরীতে কমপক্ষে তিনজন নার্স থাকার কথা, আছেন একজন। দেশে ৬৫ হাজার ৭৬৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে আছেন ৩৩ হাজার ১৮৩ জন।
সমস্যার ব্যাপকতা: সরকারি খাতে দেশের ৯টি ও বেসরকারি খাতে ১৮ নার্সিং কলেজ বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চার বছরের বিএসসি কোর্স চালু করে ২০০৮ সাল থেকে। বিএসসি কোর্সে মোট ৫৩টি বিষয় চার বছরে পড়ানো হয়। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই বললেই চলে।
ঢাকা নার্সিং কলেজে এ মুহূর্তে ছাত্রসংখ্যা ৪০০। শিক্ষকের নিয়মিত পদে আছেন একজন শিক্ষক। তিনি জাসিন্তা অলিম্পিয়া গোমেজ। এর বাইরে অধ্যক্ষসহ আরও যে ২০ জন শিক্ষক আছেন, তাঁদের প্রত্যেকে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স। প্রেষণে কলেজে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজটি পরিচালিত হলেও কলেজ পরিচালনার কোনো নীতিমালা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানা হয় না।
১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট নার্সিং ইনস্টিটিউটকে ২০১১ সালে নার্সিং কলেজে রূপান্তর করা হয়। চার বছর কেটে গেছে, এখন পর্যন্ত প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক কিংবা অধ্যাপক পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কলেজটিতে ৪৩৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এর মধ্যে চার বছর মেয়াদি বিএসসি কোর্সে ৩৪৫ জন, তিন বছর মেয়াদি মিডওয়াইফারি কোর্সে ৭২ ও ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সে ২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এর বিপরীতে একজন অধ্যক্ষসহ মোট ১৭ জন প্রশিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। যে ১৭ জন প্রশিক্ষক এখানে কর্মরত আছেন, তাঁদের প্রত্যেকে মূলত জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স পদমর্যাদার। কেউ শিক্ষক নন।
রাজশাহী ও রংপুর নার্সিং কলেজ থেকেও পাওয়া গেছে একই তথ্য। নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোর চিত্রও আলাদা নয়। নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়তে হয় ৩৫টি বিষয়। নার্সিং ইনস্টিটিউট, শেরপুরের ইন্সট্রাক্টর ইনচার্জ (অধ্যক্ষ) সন্ধ্যা রানী পাল জানান, ইনস্টিটিউটটি চালাতে অন্তত ১০ জন শিক্ষক দরকার, আছেন তিনজন।
কলেজ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নার্সিং যাঁরা পড়ছেন তাঁদেরও এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের মতো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলজি ও প্যাথোফিজিওলজির মতো মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে হয়। মেডিকেল কলেজগুলোয় এ বিষয়ের শিক্ষকের সংকট রয়েছে।
ঢাকা নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষকেরা মেডিকেল কলেজে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে নিজেদের পছন্দমতো সময়ে নার্সিং কলেজে ক্লাস নেন। কোনো রুটিন নেই। কখনো বিকেলে, কখনো ছুটির দিনে আবার কখনো টানা তিন-চার ঘণ্টা ক্লাস নিয়ে তাঁরা কোনোরকমে কোর্স শেষ করান।
মৌলিক বিজ্ঞান ছাড়াও সমাজবিজ্ঞান, ইংরেজি ও কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়াতেও অতিথি শিক্ষকদের ডেকে আনা হয়। শেরপুর নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বলেছেন, জেলা হাসপাতালের পরামর্শক চিকিৎসকদের অনুরোধ করে ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। সমাজবিজ্ঞান, ইংরেজি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ানোর জন্য ডাকা হয় সরকারি বা বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের। সার্বক্ষণিক কোনো শিক্ষক নেই।
বিশেষায়িত সেবার জন্য নার্সিংয়ে যে বিষয়গুলো পড়ানো হয়, সেগুলো পড়ানোর জন্যও যথেষ্ট শিক্ষক নেই। বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের তথ্যমতে, ১২৩টি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কর্মরত নার্সদের মধ্যে মনোরোগের সেবাদানকারী নার্সের সংখ্যা ৮২ জন, চোখের রোগীদের জন্য ৩১, শিশু রোগীদের জন্য ৬০, হৃদ্রোগের ১৯৭ জন ও বক্ষব্যাধিতে ৪৩ জন নার্স আছেন।