
যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বিরাজমান থাকা একান্তই জরুরি। স্বচ্ছতা বলতে বোঝায় প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ড এমনভাবে পরিচালিত হবে, যাতে অন্যরা বিশেষত জনসাধারণ এবং অংশীদারেরা (স্টেকহোল্ডার) তা দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে। দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি হলো প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্তসমূহের স্বীকৃত দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব সঠিক ও প্রত্যাশিতভাবে পালিত হচ্ছে কি না তা প্রমাণ বা প্রদর্শনের জন্য প্রতিষ্ঠানটি যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এবং জনগণের কাছে দায়ী। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তাদের কর্মকাণ্ড বা সেবা প্রদান সম্পর্কে তথ্য প্রদানের স্বীকৃত ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই তথ্য প্রদানের ব্যবস্থাই হলো ‘মাধ্যম’, যা স্বচ্ছতাকে বৃদ্ধি করে এবং দায়বদ্ধতাকে নিশ্চিত করে।
প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত অর্থাৎ সকল স্তরের প্রতিষ্ঠানে ওই দুটি মৌলিক উপাদান কার্যকরভাবে বিদ্যমান থাকতে হবে এবং তা দৃশ্যমান হতে হবে। অন্যথায় সেই সরকারকে গণতান্ত্রিক হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। উল্লেখ্য, একটি রাষ্ট্রের সরকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হলেই তাকে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক বলা যায় না। গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য নির্বাচন অবশ্যই পূর্বশর্ত, কিন্তু যথেষ্ট নয়। প্রকৃত গণতান্ত্রিক হতে হলে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ হতে হবে। তদুপরি তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ এবং প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
এখন দেখা যাক, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ডে ও তাদের পরিচালনা ব্যবস্থায় এই স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বিদ্যমান আছে কি না। থাকলে তা যথেষ্ট কি না এবং যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়েছে তা সাধিত হচ্ছে কি না।
প্রথমেই ধরা যাক, নির্বাহী বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান মন্ত্রিসভাকে। দেশের সংবিধানের ৫৫(৩) ধারার বিধান অনুসারে জাতীয় সংসদের কাছে মন্ত্রিসভা যৌথভাবে দায়ী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতীয় সংসদের কাছে মন্ত্রিসভা কতটুকু দায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। সে প্রশ্ন হলো, জাতীয় সংসদ কি কার্যকর? স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সংসদের কার্যকারিতা হারানো শুরু হয়। কারণ অনেক। গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হলো বিরোধী দল কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে সংসদের অধিবেশন বর্জন, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময়, আলাপ-আলোচনার বা সমঝোতার প্রকট অভাব এবং আলাপ-আলোচনার পরিবেশের অনুপস্থিতি, পরমতসহিষ্ণুতার অনুপস্থিতি, অধিবেশনে অত্যন্ত নিম্নমানের আলোচনা, অরুচিকর ও অশ্লীল ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রদান, বিরোধী দল কর্তৃক আনীত মুলতবি প্রস্তাব বা জনগুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবাদি সংসদে আলোচনার সুযোগ না দেওয়া, কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ওপর সংসদে আলোচনা না হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, যার কারণে সরকার বা বিরোধী দলের কোনো সদস্য তাঁদের নিজ নিজ দলের অবস্থানের বিপক্ষে কথা বলার অধিকার রাখেন না। সর্বোপরি সংসদ নেতা, দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হওয়ায় (যা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে) সংসদ মোটামুটিভাবে চালিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুসারে। আরও দেখা গেছে, সংসদ অধিবেশনসমূহে সদস্যদের উপস্থিতি ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নৈরাশ্যজনক।
ওপরে বর্ণিত বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে আমাদের সংসদ কার্যত অকার্যকর। সংসদ কার্যকর না থাকলে মন্ত্রিসভাকে দায়বদ্ধ রাখার সুযোগ অনুপস্থিত থাকবেই। বিশেষ করে যেখানে প্রধানমন্ত্রী (সংসদ নেতাও বটে) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। সংবিধানের ৪৮ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি দুটি ক্ষেত্র ব্যতীত সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শদান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ দান করেছেন তা কোনো আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না। ফলে এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত রয়েছে।
সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের ৫৫(২) ধারা অনুযায়ী, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’ এখানে কিন্তু মন্ত্রিসভার কথা বলা হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী কার কাছে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রপতি কিংবা মন্ত্রিসভার কাছে তিনি দায়বদ্ধ নন। তিনি মন্ত্রিসভার সব সদস্যসহ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী, তবে যতক্ষণ সংবিধানের ৫৭(২) ধারা অনুসারে তিনি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন না হারান। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারানোর মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া বলতে গেলে অসম্ভব। সরকারের কার্যবিধি (রুলস অব বিজনেস) পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সব ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। অথচ তিনি প্রকৃতপক্ষে কারও কাছে দায়বদ্ধ নন। তাঁর আদেশ বা ইঙ্গিত ব্যতীত প্রশাসন স্থবির হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে দেশে চলছে প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা। ব্যতিক্রম একটাই, তা হলো সাধারণ নির্বাচনের সময় যখন তাঁকে জনতার মুখোমুখি হতে হয়।
জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সার্বিকভাবে সরকার পরিচালনার জন্য দায়ী। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ জাতীয় সংসদের মৌলিক দায়িত্ব তিনটি। ১. জনগণের বা নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করা, ২. আইন প্রণয়ন ও ৩. সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ওপর সতত পর্যবেক্ষণ করা। এই দায়িত্বসমূহ কার্যকরভাবে পালন করা হচ্ছে কি না তা দেখার সুযোগ জনগণ খুব কমই পেয়ে থাকে। কোনো সাংসদ তাঁর দায়িত্ব পালন ব্যর্থ হলে বা তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁকে দায়বদ্ধ করার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর সমষ্টিগতভাবে সাংসদেরা কতটুকু দায়বদ্ধ তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এককথায় বলা যায়, আমাদের সংসদ অকার্যকর। সুতরাং তার দায়বদ্ধতাও কার্যকর নয়। সংসদ বয়কট করলে বা সংসদে নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে নির্বাচকমণ্ডলী সংসদে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হন। দ্বিতীয়ত, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সংসদে আইন প্রণয়নের ওপর আলোচনা আশানুরূপ মানের হয় না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিল অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে সংসদে আইনে প্রণীত হওয়ার প্রচুর উদাহরণ আছে। বিরোধী দলের সংশোধনী প্রস্তাব বা জনমত যাচাইয়ের দাবি সাধারণত উপেক্ষাই করা হয়। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের বাজেট অনুমোদন সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু সংবিধান এবং সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে অনেক বিধিনিষেধ বর্তমান থাকায় বাজেট প্রস্তাব পরীক্ষা এবং তা অনুমোদনের কাজও যেভাবে হয়, তা বাঞ্ছনীয় নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। উল্লেখ্য, বাজেটের জন্য বরাদ্দকৃত সময় অপ্রতুল, বাজেট বক্তৃতায় অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উত্থাপিত হয় এবং মূল্যবান বক্তব্য খুব কমই হয়। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারির কাজে ইদানীং অর্থাৎ নবম সংসদে কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে, যদিও নানা জটিলতায় তা আশানুরূপ হয়নি।
এরপর আসা যাক বিচারব্যবস্থায়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। তবে তা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনাক্রমে করতে হয়। এটা রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নয়। তাঁকে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রধান বিচারপতি কী পরামর্শ দিয়েছেন তা এবং প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বিবেচনায় নিয়েছেন কি না তা জানার কোনো সুযোগ নেই। এর সরল অর্থ দাঁড়ায়, সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে রয়েছে। রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধান বিচারপতিকে নিজের ক্ষমতায় নিয়োগ করবেন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন, তাতে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে রাষ্ট্রপতি স্বীয় বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। বর্ণিত অবস্থা পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সর্বোচ্চ আদালত গঠনে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার বিধান অনুপস্থিত। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের আমলে ৬১ জন বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন। এত অধিকসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা ছিল কি না তা জানা যায় না এবং এর ফলে বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে কি না তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। সুপ্রিম কোর্টে তিনি বিচারক নিযুক্ত হবেন, তাঁর সুপ্রিম কোর্টে কমপক্ষে ১০ বছর কাল অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ কাজ করার অভিজ্ঞতা অথবা কমপক্ষে ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এখানে কোনো কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। কী পদ্ধতিতে একজন অ্যাডভোকেট বা একজন বিচারিক কর্মকর্তা সুপ্রিম কোর্টের জন্য মনোনীত হন বা কোন মাপকাঠিতে যোগ্যতা নিরূপণ করা হয় তা একবারেই অস্বচ্ছ এবং এসব নিয়োগে কোনো পর্যায়েই দায়বদ্ধতার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ওপরে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের তিনটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হলে অনেক কাঠামোগত ও মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে।
যেহেতু তিনটি সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার অনেক ঘাটতি আছে, সেহেতু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনে প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা থাকবে তা আশা করা যায় না। বাস্তব পরিস্থিতিও তা-ই। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড। সব দেশেই আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের দাবিদার। এসব দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত। তারা তাদের এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা নিরূপণ করা বা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করার কোনো স্বচ্ছ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দেশে অনুপস্থিত। পুলিশের দায়িত্ব পালন নিয়ে সীমাহীন অভিযোগ আছে। কিন্তু পুলিশ কার কাছে দায়ী, তারা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য পুলিশ প্রশাসনের বাইরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। র্যাবের ‘ক্রসফায়ার’ এ ক্ষেত্রে একটা বড় দৃষ্টান্ত। ক্রসফায়ারের ঘটনাসমূহের কোনো তদন্ত হয়েছে কি না বা তদন্তে কে দোষী সাব্যস্ত হলো তা জনসাধারণ কিংবা ভুক্তভোগী পরিবার জানতে পারে না।
দেশের অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে আছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ ইত্যাদি। তাদের কাজের মধ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য অন্তহীন অভিযোগ আছে। এর মূল কারণ তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একই অবস্থা বিরাজ করছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রশাসনেও, হাসপাতালে—বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলের হাসপাতালে—ডাক্তারের অনুপস্থিতি, ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসার সরঞ্জামের অভাব ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও কোচিং-বাণিজ্য সম্পর্কে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের গভর্নিং বডির দায়িত্ব শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা। কিন্তু গভর্নিং বডিসমূহ রাজনৈতিকীকরণের ফলে এ ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একাধিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এবং অনেক দেশি-বিদেশি পরামর্শক কাজ করেছেন। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি।
স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা হলো সুশাসনের ভিত্তি, যেহেতু দেশের প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এসবের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে, সেহেতু দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সুদূরপরাহত। এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার একটি বড় কারণ সর্বক্ষেত্রে প্রশাসনকে দলীয়করণ করা। প্রতিষ্ঠানসমূহের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলীয় আনুগত্যকেই সবচেয়ে বড় কর্তব্য বিবেচনা করে থাকেন, সেবা প্রদান বা প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্দেশ্য পূরণ গৌণ বিষয় হয়ে গেছে। এহেন পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা কার্যকর করা কঠিন হয়ে গেছে।
অনেক হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও একটি অত্যন্ত ইতিবাচক অর্জন আছে। তা হলো তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন এবং তথ্য অধিকার কমিশন গঠন, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করতে এই আইন এবং কমিশন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন আইনটির ব্যাপক প্রচার এবং জনগণকে সচেতন করে তোলা।
এম হাফিজউদ্দিন খান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা