Thank you for trying Sticky AMP!!

সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণ কমবে?

ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে সারা দেশে চলতে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি।

সিলেটে গৃহবধূকে ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একজন নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। আন্দোলনকারীদের বড় অংশের দাবির মুখে সরকার এখন বলছে, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০৩ (সংশোধিত) অনুযায়ী। এ আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। ধর্ষণের কারণে কারও মৃত্যু হলে কিংবা গণধর্ষণে সম্পৃক্ত হলে প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রথম আইনটি ছিল, নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩। ১৯৯৫ ও ২০০০ সালে নতুন আইন আসে। সবশেষ সংশোধনী আসে ২০০৩ সালে। সব আইনেই ধর্ষণের শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তবে শাস্তির হার ছিল খুবই কম। প্রথম আলোর গবেষণা বলছে, ধর্ষণ মামলায় সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ।

চলমান আন্দোলনে ছাত্র-শিক্ষক-সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও এর সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলো মনে করছে, বিদ্যমান আইনে কঠোর শাস্তির অভাবে ধর্ষণের বিচার হচ্ছে না। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, আসলে জনগণ চায় ধর্ষণকারীর এমন সাজা, যেন কেউ আর এ ধরনের অপরাধে না জড়ায়। এই চাওয়া থেকেই মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হচ্ছে। যদি প্রকাশ্যে দু-একবারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তাহলে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হবে। কেউ আর ধর্ষণে জড়াবে না। বিদ্যমান আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও সাজা হচ্ছে খুবই কমসংখ্যক অপরাধীর। অনেক ক্ষেত্রে অল্প কদিন পরেই আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।

তবে এই দাবির কিছু নেতিবাচক দিকের কথা তুলে ধরেছেন কেউ কেউ। শওকত হোসেন নামের একজন বিচারক তাঁর শঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তিনি লিখেছেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণের পর ভিকটিমকে (ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু) হত্যার প্রবণতা বাড়বে। বেশির ভাগ সময় ধর্ষণের শিকার এবং ধর্ষক পরস্পরের পরিচিত হয়ে থাকেন, বিশেষ করে শিশুদের বেলায়। এতে শিশুরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হলে ধর্ষণের অপরাধে নালিশ করার প্রবণতাও অনেক কমে যাবে। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর ওপর পারিবারিক ও সামাজিক চাপ আসবে স্থানীয়ভাবে সমাধানের। বিচার চাওয়ার হার কমে গেলে ধর্ষণের সংখ্যা উল্টো বেড়ে যেতে পারে।

প্রায় দুই বছর ধরে ধর্ষণ আইন সংস্কারের কাজ করছে ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এই জোটকে সাচিবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। ব্লাস্টের রিসার্চ স্পেশালিস্ট তাকবীর হুদা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনে করেন না যে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হলেই ধর্ষণ কমে যাবে। এটি ভুল ধারণা। সাজা নিশ্চিত করতে গোড়ায় হাত দিতে হবে। কিন্তু সেদিকেই নজরটা কম।

তাকবীর বলছিলেন, ধর্ষণের রায় পর্যন্ত পৌঁছাতে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ধর্ষকেরা সাধারণভাবে সমাজে প্রভাবশালী অংশের সদস্য হয়ে থাকেন। তাঁরা প্রথমেই ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু যেন থানায় গিয়ে মামলা করতে না পারে, সেই চেষ্টা চালান। তারপরও মামলা হলে বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা বাধার সৃষ্টি করবে। আর সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকলে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলেও নারী ও শিশুরা বেশি সংখ্যায় থানায় বা আদালতে যাবে না।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে আইন কমিশন এ-সম্পর্কিত প্রথম খসড়া তৈরি করেছিল। ২০১১ সালে এটি পর্যালোচনাও করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়নি।

তাকবীর হুদা সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, এই ধারা বহাল থাকায় অভিযোগকারী বিচার শুরুর পরও নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সাক্ষ্য আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।’

ভারতে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইন বাতিল করেছে, তবে বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অব্যাহত দাবির পরও এ আইন বাতিলের কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেই।

ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট ইতিমধ্যে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। জোট দাবি করছে, সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকেরা যেন সুবিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন, আইনে সেই ব্যবস্থার বিধান রাখতে হবে। এর পেছনে তাদের যুক্তি হলো, যে অপরাধে সাজা যত কঠোর, ঐতিহাসিকভাবে তার প্রয়োগ তত কম হয়ে এসেছে। বিচারকদের হাতে যখন মৃত্যুদণ্ড এবং খালাস ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকে না, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ন্যায়বিচার করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যান। এ ক্ষেত্রে তাঁদের দাবি হলো, শাস্তির আনুপাতিকতা নিশ্চিত করা এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির (যেমন অস্ত্রের ব্যবহার, বলপ্রয়োগ বা সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির স্থায়ী শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি) বিবেচনা করা।

ধর্ষণ আইন সংস্কার জোটের সদস্যরা হলো আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), উইক্যান, উইমেন ফর উইমেন, একশনএইড, অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন, ওয়াইডব্লিউসিএ, কেয়ার বাংলাদেশ, জাস্টিস ফর অল নাউ, ডব্লিউডিডিএফ, নারীপক্ষ, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, ব্র্যাক, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘জনগণের কাছ থেকেই তো দাবিটা উঠেছে। এখন এটাকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এই দাবিটা বিবেচনা করব। তার কারণ হচ্ছে, আমরা ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য যা যা করণীয়, সেটা করার চেষ্টা করব। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যেটা বিবেচনা করব, সেটা হচ্ছে, আবারও এই আইনটা সংশোধন করে এটা আনা যায় কি না।’ তবে এই দাবির ভালো-মন্দ দুই দিকই বিবেচনা করা হবে বলে জানান তিনি।

রোববার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মনে হয়, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলে কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধ করার আগে অনেকবার ভাববে।’

এদিকে রোববার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে ধর্ষণের দায়ে ফাঁসি নয়, বরং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দাবি জানিয়েছেন। রাজধানীর ক্র্যাব মিলনায়তনে আয়োজিত সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে তানহা তানজীম বলেন, ধর্ষণ আইন পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ধর্ষকের এবং সীমা ভেদে সব যৌন হয়রানির সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি ভিকটিমের স্বার্থে লঘু শাস্তিরও বিধান রাখতে হবে।