
সন্ধ্যা ও রাতে ৮–১০টি বুনো রাজহাঁস বিলের জল ছেড়ে ধানখেতে উঠে আধা পাকা ধান খাচ্ছে রোজই। ওগুলোর পায়ের চাপে ও ডানার ঝাপটায় পাকা ধান ঝরে যাচ্ছে, নরম কাদামাটিতে লেপ্টে থাকছে ধানের শিষ। একজন দরিদ্র বর্গাচাষি এক সকালে এলেন আমাদের বাড়িতে। আমার বাবাসহ মোট তিনজন রওনা হয়ে গেলেন ওই বর্গাচাষির সঙ্গে। তিনজনের হাতেই বন্দুক।Ñ ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁরা তিনজন। পাশের গ্রাম জাড়িয়ার বিখ্যাত-বিশাল ‘ভাটকার’ বিলে পৌঁছালেন।
পৌষের কনকনে শীত। শনশনে উত্তুরে হাওয়ার মধ্যেই একজন তালের ডোঙায় চড়ে রওনা হলেন মধ্যবিলের দিকে। কেননা, বিলপাড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল রাজহাঁসগুলোকে বন্দুকের রেঞ্জে আনা যাবে না। ডোঙা যতই এগোয়, হাঁসগুলো ততই পিছিয়ে যায়। আর রাজহাঁসগুলোর এপাশে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁসের ঝাঁকগুলো উড়াল দিয়ে একটু ঘুরে গিয়ে নামে।
লম্বা গলার রাজহাঁসগুলো খুবই হুঁশিয়ার। বিপদ বুঝলে দেবে উড়াল, সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁসগুলোও দেবে উড়াল। জলে ভাসমান অন্য পাখিরাও রাজহাঁসকে ‘ঢাল’ বা প্রতিরক্ষাব্যূহ হিসেবে ব্যবহার করে। যাহোক, অনেক চেষ্টার পরও রাজহাঁসগুলো দুই–তিনবার উড়ল। Ñ‘কোয়াঙ কোয়াঙ’ ধাতব জোরালো কণ্ঠে ডাকতে ডাকতে আরও দূরে গিয়ে নামল জলে। নেমেই চুপ। অন্য বুনো হাঁসগুলো ও জলে ভাসমান অন্য পাখিরাও ওই দুই–তিনবারই রাজহাঁসগুলোর ওপাশে গিয়ে নামল। শিকারি ও ওগুলোর মাঝখানে রাজহংস-ঢাল। আবারও উড়ল রাজহাঁসগুলো। মরিয়া শিকারি রেঞ্জের শেষ সীমানায় থাকা হাঁসগুলোর ঝাঁকে ‘উড়ো গুলি’ করলেন, একটি রাজহাঁস গুলিবিদ্ধ হলো। ১০–১২ হাত নিচেও পড়ল, কিন্তু শূন্যে ব্রেক কষে আবারও দিল উড়াল, ঝাঁকে মিশে চলে গেল দূরের অন্য কোনো বিলের দিকে।
এ ঘটনা ১৯৩৮ সালের। আমার বাবা ও তাঁর দুই বন্ধু (একই গ্রামের) মিলে কলকাতায় গিয়ে একই রকম বন্দুক কিনে এনেছিলেন, যা ‘মেড ইন ইংল্যান্ড’। বাবার কাছেই শুনেছিলামÑ চরাট বা ধূসর রাজহাঁস (Greyleg Goose) ও সাদা রাজহাঁস (Bar-headed Goose) পাকা ধানখেত ও শর্ষেখেতের ক্ষতি বেশি করে। মূলত এরা নিশাচর। দিনটা ঘুমিয়ে ঝিমিয়ে নিরাপদ-নিরুপদ্রব জলাশয়ে আয়েশ করে কাটায়। নিরিবিলি পরিবেশে দিনেও ডাঙা বা নদীর পাড়ের ঘাসবনে ঘুরে ঘাসও খায়। মসুরের ডাল খুব প্রিয়। বাবা বলেছেন, ভ্যাটকার বিলের হাঁসগুলো ছিল সাদা রাজহাঁস বা রাজহংসী।
ওই ঘটনার ১৫ বছর পরে জন্ম আমার। ওই বন্দুক একসময় আমার হাতেও উঠেছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই বন্দুক চলে গিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর হাতে।
সাদা রাজহাঁস বা রাজহংসীদের মূল খাবার হলো ঘাস, শস্য, জলজ উদ্ভিদগুল্ম ও শিকড়-বাকড়, গুগলি-শামুক ইত্যাদি। দেখতে সুন্দর এই রাজহাঁস একনজরে চকচকে ধূসর-ছাই। সারা শরীরে অস্পষ্ট বাদামি ও সাদা চিহ্ন। মাথা-চিবুক ও ঘাড়ের পাশটা চকচকে সাদা। এক চোখের পাশ থেকে শুরু করে ঘন বাদামি একটি রেখা মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে অন্য চোখটির পাশে এসে মিশেছে। তার নিচে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে একই রকম আরেকটি রেখা চলে গেছে। এ দুটি রেখা রাজহাঁসটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। পেট সাদা। টকটকে হলুদ ঠোঁটের আগাটা কালো। পা ও পায়ের পাতাও হলুদ। এরা দল বেঁধে আকাশে ওড়ার সময় ইংরেজি ‘ভি’ ‘ডব্লিউ’ ও ‘এম’-এর মতো ওড়ে।
শীতের পরিযায়ী এ রাজহাঁসগুলো বড় বড় হাওর-উপকূল-মোহনা ও নদীচরে দেখা মেলে। এটির ইংরেজি নাম Bar-headed Goose। বৈজ্ঞানিক নাম anser indicus। দৈর্ঘ্য ৭৪ সেন্টিমিটার।