Thank you for trying Sticky AMP!!

সুফলা মাঠে নিষ্ফলা কৃষক

কালিহাতীর বানকিনা গ্রামের খেতে ধান কাটতে আসা শ্রমিকেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান

৭০ বছর বয়সী কৃষক রমেজ আলীর মন ভালো নেই। মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা। চার মাসের বেশি সময় ধরে রাত–দিন কষ্টের ফলাফল এখন শূন্য। হিসাব মিলছে না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছেন, ‘এ কী হলো? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।’ ভালো ফলনের আশায় যেখানে যা খরচ করার দরকার ছিল, তাতে কমতি রাখেননি। তাঁর ধানের ফলনও খারাপ হয়নি। তারপরও কেন লোকসান?

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামের কৃষক রমেজ আলীর সঙ্গে দেখা হয় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। হতাশার সঙ্গে এসব হিসাব তুলে ধরছিলেন প্রথম আলোর কাছে। বললেন, ‘ধান লাগায়ে বহু নস (লোকসান) খাইছি। কামলার পেছনে টাকা লেগেছে। নিড়ানি, সারের পেছনে বহু টাকা গ্যাছে গা। সারের বস্তা কিনছি ২৫০০ টাকা করে। অহন তো আমাগো মরণ।’


৯৬ মণ ধান উৎপাদন করে তাঁর ঘরে কতটুকু উঠল, হাত নেড়ে নেড়ে সেই হিসাব দিয়ে বরগা চাষি রমেজ আলী জানালেন, এবার ছয় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এর মধ্যে তাঁর নিজের জমি দুই বিঘা। প্রতি বিঘায় পেয়েছেন ১৬ মণ ধান। ছয় বিঘা জমিতে মোট ধান পেয়েছেন ৯৬ মণ। ভাগে নেওয়া জমির ফলনের অর্ধেক মালিককে দিতে হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী চার বিঘা জমির মালিককে দিয়েছেন ৩২ মণ ধান। মালিককে দিয়ে তাঁর কাছে ধান ছিল ৬৪ মণ। আবার সেচদাতাকে দিতে হয়েছে আরও ২৪ মণ। এক বিঘা জমিতে যে ফলন হয়, তার সিকিভাগ দিতে হয় সেচদাতাকে। অর্থাৎ ফলনের চার ভাগের এক ভাগ ধানের মালিক সেচদাতা নিজে। সবাইকে দিয়ে–থুয়ে রমেজ আলীর গোলায় ধান উঠেছে মাত্র ৪০ মণ।



কতটুকু ধান তিনি পেলেন, সেই হিসাব দেওয়ার পর শুরু করলেন চাষের পেছনের খরচের হিসাব। এত কষ্টের চাষের পর নিজের গোলায় বেশি ধান ওঠাতে মন চায়। বরগা চাষি বলে চাষের আগেই মোটামুটি ধারণা ছিল, এমন ভাগ-বাঁটোয়ারার পর কতটুকু নিজে পাবেন। তাই সেই হিসাবটুকু তাও না হয় মেনে নেওয়া যায়। তবে কত খরচ হলো, সেই খাতা খুলে বসলে আর কিছুই ভালো লাগে না। মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়।

কালিহাতীর ছাতিহাটি গ্রামের কৃষক রমেজ আলী। ছবি: আসাদুজ্জামান


চারা রোপণ থেকে ধান কাটা পর্যন্ত যত খরচ
রমিজ আলীর হিসাব অনুযায়ী, ছয় বিঘা জমিতে ধান চাষের জন্য প্রথমে তিনি বীজ কেনেন ৬০ কেজি। এক বিঘা জমির জন্য ১০ কেজি ধানের বীজ বপন করতে হয়। ১০ কেজি ধানের বীজে খরচ পড়েছিল ৫৪০ টাকা। ধানের চারা রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত বাবদ খরচ হয়েছিল ছয় হাজার টাকা। এই টাকা তাঁর খরচ হয়েছিল ট্রাক্টর ও শ্রমিকের পেছনে। ধান রোপণের পরপরই জমিতে সার দেন। এক বিঘা জমিতে প্রথম দফায় সার বাবদ খরচ হয় ১ হাজার ২৮০ টাকা। ছয় বিঘার জন্য খরচ সাত হাজার টাকারও বেশি। সার দেওয়ার কিছুদিন পর জমিতে আগাছা জন্মায়। আগাছা পরিষ্কার করতে লাগান শ্রমিক। তখন শ্রমিকের পেছনে আবার খরচ হয় সাত হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে ছয়জন করে শ্রমিক কাজ করেন। তখন একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি ছিল ৩০০ টাকা। এর প্রায় এক মাস পর আবার জমিতে দেন সার ও কীটনাশক। তখন সার বাবদ আবার বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১ হাজার ২৮০ টাকা। সব খরচ ছাপিয়ে গেল ধান কাটা শ্রমিকের পেছনে। একজন শ্রমিককে প্রতিদিন দিতে হয়েছে ৮০০ টাকা করে। এক বিঘা জমির ধান ওঠানোর জন্য ছয়জন করে শ্রমিক লেগেছে। সেই হিসাবে রমিজ আলীর শ্রমিকের পেছনে খরচ হয়েছে ২৮ হাজার টাকারও বেশি।

কালিহাতীর বানকিনা গ্রামের কৃষক মালেক শিকদার। ছবি: আসাদুজ্জামান

‘এইবার হিসাব করেন, চারা রোপণ থেকে ধান কাটা পর্যন্ত কত খরচ হলো’—প্রতিবেদককেই হিসাবটা কষতে দিলেন রমিজ আলী। ওই সময় প্রতিবেদকের হয়ে আরেক কৃষক নূর ইসলাম রমেজ আলীর ধান চাষের হিসাবটা কষে দিলেন। বললেন, ধানের বীজ কেনা থেকে শুরু করে ধান ওঠানো পর্যন্ত এক বিঘা জমির পেছনে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার টাকার মতো।

ছাতিহাটি বাজারে বসে রমেজ আলী যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন সেখানে জড়ো হন গ্রামের আরও পাঁচজন কৃষক। এঁদের একজন হলেন ৬০ বছর বয়সী নূর ইসলাম।

কালিহাতীর ছাতিহাটি গ্রামের কৃষক নূর ইসলাম। ছবি: আসাদুজ্জামান

নূর ইসলাম একজন সেচদাতা। পাশাপাশি নিজের দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন তিনি। নূর ইসলাম বললেন, হিসাব কষে তিনি দেখেছেন, ধানের বীজ কেনা থেকে শুরু করে ধান ওঠানো পর্যন্ত এক বিঘা জমির পেছনে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার টাকার মতো। বিঘাপ্রতি ১৬ মণ ধান পাচ্ছেন কৃষক। সেই ধানের দাম মাত্র আট হাজার টাকা। কারণ, ধানের মণ এখন মাত্র ৫০০ টাকা করে। অর্থাৎ, এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে আট হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।

কালিহাতীর ছাতিহাটি গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়া ছবি: আসাদুজ্জামান

ছাতিহাটি গ্রামের আরেক কৃষক সুরুজ্জামান। নিজের দেড় বিঘা জমিতে তিনি ধান চাষ করেন। ধান পেয়েছেন ২৪ মণ। এর থেকে সেচদাতাকে দিয়েছেন ছয় মণ। ঘরে আছে এখন মাত্র ১৮ মণ ধান। সুরুজ্জামান বললেন, ‘কামলার টাকা দিতে হবে। ধান ব্যাচন লাগে। অহন ধানের দাম মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা।’

কালিহাতীর ছাতিহাটি গ্রামের কৃষক সুরুজ্জামান। ছবি: আসাদুজ্জামান

তিন বিঘা জমি ভাগে নিয়ে ধান চাষ করেন ৭০ বছর বয়সী আবদুল জলিল। বরগা চাষি জলিল প্রথম আলোকে বললেন, বহু আশা নিয়ে তিনি ধান চাষ করেছিলেন। ধান কাটার পর এখন চোখে–মুখে অন্ধকার দেখছেন। সবাইকে দিয়ে–থুয়ে যে ধান তাঁর ঘরে আছে, তাতে কামলার পেছনে যে খরচ হয়েছে, তাও উঠছে না।

ছাতিহাটি গ্রামের এসব দরিদ্র কৃষক সমস্বরে বললেন, ধান চাষে লোকসান দেখে মালিকেরা চাষ করছেন না। জমি দিচ্ছেন বরগা।

৬০ বছর বয়সী বরগা চাষি দুলাল মিয়া বললেন, ‘অহন আমাগো মরণদশা।’

আরও পড়ুন:
ক্ষমা করিও পিতা, কৃষক মরিলেই তো লাভ!
কৃষকের পাশে ছাত্ররা আছে, সরকার নেই!
অন্ধ হলে কি প্রণয় বন্ধ থাকে
বাজারেও আগুন, ধানখেতেও আগুন!