
‘তুই আমার সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত, তুই আমার প্রতিটা মুহূর্ত, আমার বেঁচে থাকার কারণ। এখন তো শুধু দিন গোনা। কবে আবার তোকে ছুঁতে পারব, তোকে জড়িয়ে ধরতে পারব, তোর হাসিমাখা মুখটা দেখতে পাব।’ যাঁর উদ্দেশে লেখা তাঁর হাতে আর কখনো এ চিঠি পৌঁছাবে না। তবু রুবা আহমেদ চিঠি লিখেছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে অবিন্তা কবিরকে। সে চিঠির পরতে পরতে শুধুই কান্না।
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অবিন্তা কবিরের স্মরণসভায় মেয়েকে লেখা চিঠি পড়ে শোনান রুবা আহমেদ। তিনি বলছিলেন, ১৯ বছর ৪ মাসের জীবনে অবিন্তা কখনো তাঁর অবাধ্য হয়নি। স্পর্শের বাইরে চলে যাওয়া মেয়ের উদ্দেশে তাঁর এখন একটাই প্রশ্ন, ‘তুই না আমাকে বলেছিলি রাত ১০টার মধ্যেই বাড়ি ফিরবি?’ অবিন্তা তো বরাবর মাকে কথা দিয়েছেন, রেখেছেনও। শুধু একটা ঘটনা তাঁর সারা জীবনের হিসাব সব পাল্টে দিল। ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে গিয়ে অবিন্তা আর ফেরেননি। জঙ্গিদের নৃশংস হামলায় ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও তারিশি জৈনের সঙ্গে নিহত হন অবিন্তাও।
হলি আর্টিজানে হামলার পর গতকালই প্রথমবার যাঁরা অবিন্তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন অবিন্তা আসলে কে ছিলেন, কী ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর সম্ভাবনাই বা ছিল কতটুকু।
রুবা আহমেদ ও এহসানুল কবিরের একমাত্র সন্তান অবিন্তা কবির। ১৯৯৭ সালে জন্ম। দারুণ মেধাবী। জীবনের শেষ পরীক্ষায় ৪-এর মধ্যে সিজিপিএ ছিল ৩ দশমিক ৯৮। ছোটবেলায় শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন, এরপর পড়তে চেয়েছিলেন মেডিকেল স্কুলে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। একটি লক্ষ্যে তিনি স্থির ছিলেন। তা হলো তিনি বাংলাদেশে ফিরবেন, দেশের জন্য কিছু করবেন। এর বাইরে অবিন্তার অন্য পরিচয় ছিল। বাড়ির ভেতরে, আত্মীয়স্বজনের কাছে ছিলেন একটা প্রজাপতির মতো, তাঁর মায়ের সোনামণি, নানির টুনটুন, মামার বিল্লু। তাঁকে ঘিরে বাবা, দাদা, দাদু, ফুফু, খালা, মামা, খালাতো-মামাতো ভাইবোনের কতশত স্বপ্ন! এখন সবই স্মৃতি।
তবে সবার কষ্ট ছাপিয়ে গেছে অবিন্তার মা রুবা আহমেদের কান্না। তিনি মেয়ের সঙ্গে বসে দেশের জার্সি গায়ে ক্রিকেট খেলা দেখতেন, ঘুমানোর আগে চার কালেমা পড়তেন, গান গাইতেন একসঙ্গে। সবই এখন স্মৃতি। মেয়ের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি তিনি কাল পাঠ করেন, অবিন্তার ঠিকানায় আর কখনো এই চিঠি পৌঁছাবে না জেনেও।
রুবা আহমেদ তাঁর বক্তৃতায় অবিন্তার পাশাপাশি ফারাজ, তারিশির কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘তারা তিনজন ছিল বন্ধু, তিনজনই ছিল বিশেষ মূল্যবোধের অধিকারী।’
অবিন্তার মৃত্যুর পর তাঁর একটি ডায়েরি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে অবিন্তা বলেছেন, ‘আমি মানুষের জন্য চিন্তা করি। আমার লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করা। আমি বিশ্বাস করি, আজকের এই আমি, আমার সংস্কৃতি ও জাতীয়তার একটি অংশ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ আর এ দেশের জন্য কিছু করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। যদিও এনজিও প্রতিষ্ঠা করা খুব ছোট একটা পদক্ষেপ।’
অবিন্তার স্বজনেরা জানান, তিনি দেশে এলে সুবিধাবঞ্চিত শিশু, অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য কাজ করতেন। ঢাকার ধোঁয়া, ধুলো, যানজট কোনো কিছুই তাঁকে ঢাকায় আসা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
অবিন্তার নানা মনজুর মোরশেদ বলেন, ‘১৯ বছর বয়সে অবিন্তা অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছিল। পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল, কিন্তু মন পড়ে থাকত দেশে।’
বাংলাদেশের প্রতি অবিন্তার যে ভালোবাসা, তা ছুঁয়ে গেছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকেও। তিনি বলেন, অবিন্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটায় পড়ছিলেন। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। তিনি পৃথিবীকে আরও বেশি বাসযোগ্য করে যেতে চেয়েছিলেন।
অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু
গতকাল অবিন্তা কবিরের স্মরণে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। অবিন্তার পরিবার দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করবে। ওই অনুষ্ঠানে অ্যান ইন্টিমেট পোর্ট্রেট অব অবিন্তা কবির শিরোনামে বই প্রকাশ করা হয়। উদ্বোধন করা হয় একটি ওয়েবসাইটেরও।
গতকাল স্মরণসভা প্রাঙ্গণটি সাজানো হয়েছিল অবিন্তার পুতুল, মাকে লেখা চিঠি, মেডেল আর হাসিমাখা মুখের ছবি দিয়ে। দেখে মনে হচ্ছিল, অবিন্তা আছেন কোথাও, এখুনি এসে সবার সঙ্গে কথা বলবেন।