আইসিডিডিআরবির গবেষণা

স্ত্রীকে মারার অধিকার পুরুষের আছে!

বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুরুষই মনে করেন, স্ত্রীকে মার দেওয়া যায়। গ্রামের ৮৯ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে স্বামীর মার দেওয়ার অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই শহরের পুরুষেরাও, তাঁদের ক্ষেত্রে এ হার ৮৩ শতাংশ।
এ ছাড়া শহরের ৯৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৯৮ শতাংশ পুরুষই বিশ্বাস করেন, পুরুষ হতে হলে তাঁকে কঠোর হতেই হবে। আবার শহরের ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশে লিঙ্গীয় পরিচয় (জেন্ডার) এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব ও চর্চা শীর্ষক এ গবেষণায় বলা হয়েছে, শহরের ৭৭ শতাংশ এবং গ্রামের ৮১ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, যৌনতা বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে অধিকার শুধু পুরুষের। তাঁদের ইচ্ছাই প্রাধান্য পাবে। ২৯ থেকে ৩৫ শতাংশ পুরুষ তাঁদের রাগের কারণে বা নারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যৌন নির্যাতন করেন। ৫৭ থেকে ৬৭ শতাংশই শুধু মজা করার জন্য যৌন নির্যাতন করেন।
দুই হাজার ৪০০ জন পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে শহরের এক হাজার ২৫৪ জন এবং গ্রামে বসবাসকারী এক হাজার ১৪৬ জন। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) আর্থিক সহায়তায় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এ বিষয়ে এটিই বাংলাদেশে সর্বশেষ গবেষণা।
গবেষণায় পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা শুধু পুরুষের, স্বামীর বাধ্য থাকা স্ত্রীর কর্তব্য, স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে স্ত্রীর কখনোই অসম্মতি জানানো উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন বেশির ভাগ পুরুষ। ধর্ষণের শিকার নারীরও দোষ আছে, নারী যদি বাধা না দেন, তবে তা ধর্ষণ হবে না—এ ধরনের বক্তব্যও সমর্থন করেছেন বেশির ভাগ পুরুষ। আবার শহরের ৬৯ শতাংশ এবং গ্রামের ৭৮ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, যৌনতার বিষয়টি নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি দরকার। গবেষণায় নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক এ মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, নারী-পুরুষ উভয়ের দিক থেকেই নির্যাতনের বিষয়টিকে মেনে নেওয়ার যে প্রবণতা, তা নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। বেশির ভাগ পুরুষ ভেবেই নিচ্ছেন যে নারীকে নির্যাতন করা যায়। নারীদেরও শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন না থাকলে এবং বিয়ের পরে সন্তান হয়ে গেলে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীর নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেন। বাবার বাড়ি গেলেও অনেকে সেভাবে সহযোগিতা পান না। এ সুযোগটাকেই পুরুষেরা কাজে লাগাচ্ছেন।
এর আগে ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭’ জরিপেও একই ধরেনের চিত্র পাওয়া গিয়েছিল। তবে ২০১১ সালের করা জরিপের পর আরও দুই বছর চলে গেলেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এর প্রমাণ পাওয়া গেল গত সপ্তাহে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) কার্যালয়ে গিয়ে।
স্ত্রীকে আর গ্রহণ করতে রাজি নন—সেখানে আসা এমন একজন স্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধর্মে আছে, স্বামীকে না বলে এক কদমও পা বাড়ানো যায় না। আর সেই স্বামীর অনুমতি না নিয়া ও বাপের বাড়ি গেছে। বিয়ার পর ঘরের কাজকাম না কইরা খালি বাপের বাড়ি থাকত। স্নো (মুখে মাখার ক্রিম) লাগব, তা আমারে না জানাইয়া জানাইছে ওর ভাইরে। এতে কি আমার প্রেস্টিজ থাকে?’
আপনি কী চান? স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর, ‘ও (স্বামী) যদি আবার নিতে চায়, স্বামীর ঘরে যামু। মেয়েমানুষের জীবনে বিয়া একবারই হয়।’
নির্যাতিতরাই পরে নির্যাতক: যে ছেলেশিশু ছোটবেলায় বাবার হাতে মাকে মার খেতে দেখেছে অথবা নিজেই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, ভবিষ্যতে তাদেরই নির্যাতকের ভূমিকায় দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অর্থাৎ ছোটবেলার অভিজ্ঞতার সেখানেই ইতি ঘটে না। পুরুষ এবং স্বামীর ভূমিকায় তাঁরা সেই অভিজ্ঞতার প্রয়োগ ঘটান। এভাবে নারী নির্যাতনের চক্র ঘুরতেই থাকে।
আইসিডিডিআরবির ওই জরিপে এমনটাও বলা হয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, গ্রামে যে ছেলেরা ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তাদের পরবর্তী জীবনে স্ত্রীকে নির্যাতন করার সম্ভাবনা দ্বিগুণ থাকে। মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে গ্রাম ও শহরের দুই জায়গাতেই নির্যাতক হওয়ার সম্ভাবনা দুই গুণ বাড়িয়ে দেয়। শারীরিক নির্যাতনের শিকার শিশুরা বড় হলে তাদের মধ্যে লিঙ্গ বা জেন্ডার বৈষম্যপূর্ণ মনোভাব বেশি দেখা যায়।
বেসরকারি সংগঠন নারীপক্ষের একটি গবেষণায়ও শিশু বয়সের নির্যাতনের অভিজ্ঞতার যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, তা বেরিয়ে এসেছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা: পুরুষ অপরাধীর জীবন অভিজ্ঞতা—একটি সমীক্ষা’ নামের গবেষণা অনুযায়ী, সহিংসতাকারীর সমস্যাপূর্ণ শৈশব ও অন্যান্য অভিজ্ঞতা পরে তাঁকে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সহিংসতাকারীদের মধ্যে আক্রমণপ্রবণ আচরণ সৃষ্টি করে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্যাতনের শিকার এক নারী বলেন, ‘স্বামীর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে করে বলা যায়, তাঁর ছোটবেলাটা ভালো কাটেনি। সংসারে অভাব এবং বাবা-মায়ের ঝগড়া, মারপিট দেখে দেখেই বড় হয়েছেন। এখন টাকাপয়সা হয়েছে, কিন্তু ছোটবেলার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারেননি। কথায় কথায় বলেন, আমার মা যদি এভাবে সংসার করতে পারে, তুমি পারবা না কেন? পরিবার থেকে কখনোই মেয়েদের সম্মান করতে শেখানো হয়নি, নিজেও শেখেননি।’
আন্তর্জাতিক সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সংস্কৃতি ও শিক্ষা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পারস্পরিক সমঝোতার সম্পর্ক হিসেবে দেখতে শেখায় না। যৌনতাকেও সুস্থ সম্পর্কের অংশ হিসেবে দেখানো হয় না। ধরেই নেওয়া হয় এটি স্বামী বা পুরুষের অধিকার। স্বামী স্ত্রীকে আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখতে চান।
সালমা খান বলেন, আশপাশের দেশের মধ্যে একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশেই ‘মেরিটাল রেপ’ বা বিবাহিত নারীর সম্মতি না নিয়ে যৌন সম্পর্ক করা যায় না, করলে তা যৌন নির্যাতন এমনকি ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্বেরও কয়েকটি দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলোরও একই অবস্থা। নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই ‘মেরিটাল রেপ’কে নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলা হচ্ছে।