নারীমঞ্চ

স্যালুট এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের

মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। (বাম থেকে) পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য, হীরামণি সাঁওতাল, ফারিজা খাতুন, সাবিত্রী, রাজিয়া খাতুন ও মালতি রানী শুক্লবৈদ্য। ছবি: মনিরুল আলম
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। (বাম থেকে) পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য, হীরামণি সাঁওতাল, ফারিজা খাতুন, সাবিত্রী, রাজিয়া খাতুন ও মালতি রানী শুক্লবৈদ্য। ছবি: মনিরুল আলম

ঢাকার বনশ্রীর ই-ব্লকের একটি বাড়িতে সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন ছয় নারী। জীর্ণ, মলিন পোশাক, কোঁচকানো চামড়া, ক্ষীণ চোখের দৃষ্টি। ৪২ বছর ধরে কিছু কথা তাঁরা বুকের মধ্যে চেপে রেখেছেন। এখন বলতে চান। তাঁদের কেউ সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছেন, কেউ সন্তানসহ আর্মি ক্যাম্পে অবরুদ্ধ ছিলেন দিনের পর দিন, কেউ বোমার আঘাতে হারিয়েছেন অঙ্গ।

সম্প্রতি ‘চেতনা ৭১ হবিগঞ্জ’ নামের একটি সংগঠনের মহাসচিব কেয়া চৌধুরীর উদ্যোগে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন ওই ছয় নারী। হবিগঞ্জ থেকে তাঁরা তখন ঢাকায় এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎ কার দিতে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় কেয়া চৌধুরীর বাড়ি থেকে পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য, মালতী রানী শুল্কবৈদ্য, হীরামণি, ফারিজা, সাবিত্রী আর রাজিয়া ফিরে যান চার দশক আগের এক সময়ে। তাঁদের প্রত্যেকেই তখন তরুণী, কেউ বিবাহিত, কারও একটি বা দুটি সন্তান রয়েছে।

জ্যৈষ্ঠ মাসের কোনো এক রাতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট গোছাপাড়ার একান্নবর্তী পরিবারে নেমে এসেছিল ভীষণ দুর্যোগ। পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য আর তাঁর জা মালতি রানী শুল্কবৈদ্যের সামনে রাত চারটার সময় পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে বাড়ির সব পুরুষকে। পুষ্পরানীর স্বামী রাখালচন্দ্র শুল্কবৈদ্যকে গাড়ির চাকায় বেঁধে স্ত্রী-সন্তানের চোখের সামনে দিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যায় ওরা। বাড়িঘরে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। স্বামীর ভিটায় বসে কাঁদবেন নাকি কোলের সন্তানকে বাঁচাবেন—ভেবে পান না পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য আর মালতী রানী শুল্কবৈদ্য। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। পাকিস্তানি সেনারা সে রাতের মতো ফিরে গেলেও পরের রাতে আবার ফিরে আসে। সন্তানসহ দুই নারীকে আটকে রেখে চালায় অকথ্য নির্যাতন।

কী করে মুক্তি পেলেন, এমন প্রশ্নে পুষ্পরানী জানান, যে ক্যাম্পে তাঁরা ছিলেন, সেখানে আরেক নারীর যাতায়াত ছিল। ঘটনাক্রমে ওই নারীর বোনের বাড়ি আর পুষ্পর বাবার বাড়ি ছিল একই জায়গায়। পুষ্প কাতর গলায় অনুনয় করেন, ‘আমার চাচারে খইও বোইন, আমরারে নিতায়।’ মাসের পর মাস এই নারীরা মুক্তির আশায় পথ চেয়েছিলেন। মালতী জানান, নিজের চেয়েও কোলের শিশুটির জন্য দুঃশ্চিন্তা ছিল বেশি। পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই হুমকি দিত দুই শিশুকে হত্যার।

চুনারুঘাটের চানপুর চা-বাগানের ২০ বছরের সেই মেয়ে সাবিত্রীর বয়স এখন ৬০-এর কোঠায়। কিছুই ভোলেননি তিনি। বাড়িঘর ঘেরাও করে মায়ের পাশ থেকে পাকিস্তানি সেনারা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। আট মাস দিনে তিন থেকে চারজন পাকিস্তানি সেনা নির্যাতন চালায় তাঁর ওপর। বাইরে আলো না অন্ধকার, দিন না রাত—কিছু বুঝতে পারতেন না। তবে কোনো একফাঁকে পাশের কক্ষে আটক এক নারীকে দেখতে পান। সাবিত্রী তাঁর কথা ভোলেননি। বলেন, ‘কপালে সিঁদুর ছিল, হাতে শাঁখা। মাততে ফারি নাই। ভালাভালি (চোখাচোখি) শুধু হইছে। সেও কাঁদে, আমিও কাঁদি...। সে বেঁচে আছে না মারা গেছে জানি না।’ কবে মুক্তি পেলেন, জানতে চাইলে সাবিত্রী জানান, হঠাৎ একদিন দেখেন সব দরজা-জানালা খোলা, কোথাও কেউ নেই। বাগানে ঘাস কাটছে একটি ছেলে। সাবিত্রী তখন গুরুতর অসুস্থ। ছেলেটি কোলে করে সাবিত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। কিন্তু সাবিত্রী বাঁচবেন কি না, সে নিয়ে সংশয় ছিল। সাবিত্রীর মা একমাত্র সম্বল শিল-পাটা বিক্রি করে দিলেন। সে টাকায় চিকিৎ সা হলো। সাবিত্রীর ভাষায়, ‘পথম পথম সবাই ঘিন্ন করত। কিন্তু চা-বাগানেই কাম করত শাহ আলম। সেই কইল, সবাই ঘিন্ন করতে পারে, কিন্তু আমি তোকে বিহা করমু।’ এককালের সুন্দরী সাবিত্রী এখনো ভেবে কূল পান না, কোন ‘রেজাকার’ তাঁদের বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিল।

চা-শ্রমিক হীরামণি সাঁওতালকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল। তবে ফারিজা খাতুনের গল্পটা কিছুটা আলাদা। কেন আলাদা জানতে চাইলে ফারিজা বলেন, ‘খি খইতাম। সামান্য খিচু খতা খই। মক্তবে ফড়বার গেছিলাম। দুইটা-আড়াইটার সময় ধুমার মতো গ্যাস ছাড়ল, তারপর মেশিনগানর গুলি। খত মানুষ আগাত হইছে। নয়জন তো মরিয়াই গেছে।’ ফারিজার পা’টা বোমার আঘাতে উড়ে যায়। তার পর থেকে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। দরিদ্র বাবা-মা ভাত দিতে পারলে, কাপড় দিতে পারেন না, কাপড় দিলে ভাত জোটে না। তবু গর্বভরে লেমিনেট করা একটি সনদ দেখালেন। সনদটি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সে চিঠিতে সংগ্রামী সালাম জানিয়েছেন ফারিজাকে। দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের এই নারীর দাবি এই তাঁর একমাত্র সম্বল। বাবা নেই, স্বামী-সন্তান নেই—তাঁর কেউ নেই।

পাশে কেউ না থাকায় ফারিজার মনে কষ্ট, কিন্তু রাজিয়ার মনে তীব্র ক্ষোভ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার খতা শর্ট। আমি যুদ্ধ খরসি। তেলিয়াফাড়া দিয়া অস্ত্র আউগায়া দিছি। ফাগল সাজিয়া গুরছি। খতবার মারতে চাইছে ফাক আর্মি। গ্রেনেড ছিনোনি তোমরা গ্রেনেড? আমি খাঁটালের মাঝে ভরিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বুমের সাপ্লাই দিছি। খেউ চিনে নাই, আমার এলাখাত মন্ত্রী আসে। সেউ ছিনে নাই। খার গলা ধরিয়া খানমু?’

বহু বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন তাঁরা। কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর মেয়ে কেয়া চৌধুরী তাঁদের খুঁজে বের করেছেন। এমন জায়গায় তাঁরা থাকেন, যেখানে শহরের সাহেব-সুবোরা যেতে ভয় পান। তাঁরা পেটভরে খেতে পান না, পরনে কাপড় নেই। চার দশক আগের ঘটে যাওয়া নির্যাতনের দায়ে নিকটাত্মীয়রাও এড়িয়ে চলে। তাঁদের কথা ভুলে গেছেন স্থানীয় পুরুষ মুক্তিযোদ্ধারাও। ২০০৭ সাল থেকে চেষ্টা করতে করতে অবশেষে কেয়া তাঁদের কাছে পৌঁছান। এ-মাথা ও-মাথা ছোটাছুটি করে তিনি নাম তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। তারপর গেজেটের অপেক্ষা। হ্যাঁ, অবশেষে এই বছর বিজয় দিবসের আগে ৯ ডিসেম্বর সেই অপেক্ষারও শেষ হলো।
স্যালুট বীর মুক্তিযোদ্ধা এই ছয় নারীকে।