হাওরে বোরো চাষ নিয়ে শঙ্কা

সুনামগঞ্জের হাওরে এখনো থই থই পানি। কবে পানি নামবে। কবে শুরু হবে বোরো আবাদ—শঙ্কিত কৃষক। সম্প্রতি শনির হাওরের পশ্চিম পাড়ের বেড়িবাঁধে l প্রথম আলো
সুনামগঞ্জের হাওরে এখনো থই থই পানি। কবে পানি নামবে। কবে শুরু হবে বোরো আবাদ—শঙ্কিত কৃষক। সম্প্রতি শনির হাওরের পশ্চিম পাড়ের বেড়িবাঁধে l প্রথম আলো

সুনামগঞ্জের ২৮টি হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ৫৬টি জলকপাট (স্লুইসগেট) রয়েছে। কিন্তু এসবের অধিকাংশই এখন অকেজো। ফলে হাওর থেকে পানি নামছে ধীরে। এতে বিপাকে পড়েছে কৃষক। বিলম্বিত হচ্ছে বোরো আবাদ।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় হাওরের পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ৩০ লাখ টাকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, হাওর এলাকায় এখন নদী এবং হাওরের পানির উচ্চতা প্রায় সমান। তাই হাওর থেকে পানি নদীতে নামতে পারছে না। প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে শেষ দিকে বোরো আবাদে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করা হচ্ছে।

কিন্তু এরপরও শঙ্কিত কৃষক। বোরো আবাদ পেছালে ফলন ঘরে তোলাও পেছাবে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল বোরো আবাদ পেছালে গতবারের মতো ফসলহানির ধাক্কা এলে তখন কী হবে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা।

হাওর এলাকায় মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কা থাকে। এ সময় হাওরের ধান পাকতে শুরু করে। গত বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে পাহাড়ি ঢলে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরে ফসলহানি ঘটেছিল। ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসলের মধ্যে সরকারি হিসাবেই সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ ছিল।

সুনামগঞ্জের অন্যতম বড় ফসলি হাওর শনির হাওরে চারটি জলকপাট আছে। এর মধ্যে হাওরের দক্ষিণপাড়ে বগিয়ানি এলাকায় তিনটি এবং পশ্চিমপাড়ে মারালা গ্রামের পাশে আহম্মকখালী এলাকায় আরও একটি। চারটির মধ্যে তিনটি দীর্ঘদিন থেকে কোনো কাজে আসছে না।

শুধু শনির হাওর নয়, এবার এ সমস্যা দেখা দিয়েছে জেলার প্রায় সব হাওরে। ফলে এই সময়ে বোরো আবাদ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গত মৌসুমে ফসলহারা কৃষকদের অনেকেই আবার বোরো আবাদ করবেন কি না, এ নিয়ে দোলাচলে আছেন। তাঁরা বলছেন, বোরো মৌসুমে বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহে। হাওরপারের উঁচু স্থানে (স্থানীয়ভাবে এ স্থানকে কান্দা বলে) বীজতলা করা হয়। কিন্তু এবার বীজতলার কাজ প্রায় ১৫ দিন পিছিয়েছে। তাই বোরো আবাদও পেছাবে ১৫ দিন। দেরিতে ধান লাগালে সেই ধান পাকবেও দেরিতে। তখন হয়তো দেখা যাবে, ধান পাকার আগেই উজান থেকে ঢলের পানি চলে এসেছে।

কৃষি সম্প্রসারণের তথ্যমতে, হাওরে হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন ৫ থেকে ৬ মেট্রিক টন। শনির হাওরে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার কৃষকদের প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমি আছে। এর মধ্যে তাহিরপুর উপজেলার কৃষকের জমি বেশি। গত এপ্রিলে টানা ২২ দিন স্থানীয় কৃষক-জনপ্রতিনিধিরা হাওরের ফসলরক্ষায় বেড়িবাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ২২ এপ্রিল হাওরের একটি বাঁধ ভেঙে ঢলের পানি ঢুকে সব ধান তলিয়ে যায়।

তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে শনির হাওরের আহম্মকখালী এলাকা। ২০০২ সালে একটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়েছিল। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, মূল বেড়িবাঁধ থেকে কিছুটা সামনে মাটি ফেলে আরেকটি বাঁধের মতো করে জলকপাট নির্মাণ করা হয়েছিল। মারালা গ্রামের স্কুলশিক্ষক আজিব উদ্দিন আহমেদ জানান, এটি মাত্র দুই বছর সচল ছিল। এরপর গেটের সামনে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। শুধু পাকা স্থাপনা ছাড়া এখন আর এটির কোনো কিছুই নেই।

মারালা গ্রামের কৃষক শাহনুর মিয়া প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘বিকলগুলো সংস্কার না করে নতুন করে নির্মাণের পেছনে কার স্বার্থ এটাই বুঝি না। এ কাজে কেউ নিশ্চয়ই লাভবান হয়। না হলে একই হাওরের তিনটি স্লুইসগেট নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে কীভাবে?’

৫৬টি জলকপাটের মধ্যে ঠিক কতটি সচল আছে, এমন তথ্য পাউবোর প্রকৌশল বিভাগে নেই। গড়পরতার হিসাবে বলা হয়, প্রতিবছরই অর্ধেকের বেশি সংস্কার করে সচল করা হয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হাওরের জলকপাটগুলোর অধিকাংশই এখন কোনো কাজে আসছে না। এসব জলকপাটের সামনে পলি পড়ে ভরাট হয়ে আছে। আবার কোনোটি ফসল তোলার সময় ঢলের পানি আটকাতে মাটি ও বস্তা ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

সব জলকপাটই সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া। এ জন্য এক কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, হাওরে এই সমস্যা গত বছরও ছিল। এতে বোরো আবাদে শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হলেও শেষ দিকে কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি বলেন, পানি প্রাকৃতিকভাবেও কমে। বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। তারপরও যেখানে যে কাজ করার দরকার সেটি করা হচ্ছে।

শনির হাওর থেকে ফেরার পথে হাওরের মারালা ও ইকরামপুর গ্রামের মধ্যবর্তী বেড়িবাঁধের ওপর কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তাঁরা কেউই বড় গৃহস্থ নন। তিন একরের বেশি জমি আবাদ করেননি কখনো। হাওরের জলাবদ্ধতা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। এ হাওরের কৃষক আছমান গনি বলেন, ‘কোন আশায় ধান লাগাইতাম। সময় তো ১৫ দিন গেলগি। গত দুই বছর ধান গেছে, অবস্থা খুব খারাপ। এখন লাগাইতে লাগাইতে যদি আবার পানি আয়, তখন কি-তা করমু।’

শিক্ষক আজিব উদ্দিন জানালেন, হাওরে তাদের পরিবারের প্রায় ৩০ একর জমি আছে। সব জমি বর্গা দেন। এবার কৃষকেরা বর্গা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সুনামগঞ্জের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, ‘আমাদের সমন্বিত চেষ্টার মধ্যেও বড় নির্ভরতা কিন্তু প্রকৃতি।’ তাঁর আশা, বোরো চাষিরা যখন হাওরে নামবেন, সমন্বিত চেষ্টায় দৃশ্যপট অবশ্যই বদলাবে।