Thank you for trying Sticky AMP!!

৭৭% ডাকাতি মামলায় আসামির সাজা হয় না

১৯৯৫ সালের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকায় রেবেকা নাসরিন নামের এক স্কুলশিক্ষকের বাসায় ডাকাতি হয়েছিল। ডাকাতেরা লাইসেন্স করা চেকোস্লোভাকিয়ার দোনলা বন্দুক এবং ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকার মালামাল লুট করে নেয়। সাতজন অজ্ঞাতনামা ডাকাতকে আসামি করে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় মামলা করে রেবেকার পরিবার। ১১ বছর পর ২০০৬ সালের ১৩ মার্চ দুজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর দীর্ঘ ১১ বছর বিচারকাজ শেষে ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত অভিযুক্ত দুজনকে খালাস দেন।

আদালত রায়ে দুই আসামিকে খালাসের যে কারণগুলো উল্লেখ করেন, সেগুলো হলো আসামি শনাক্তকরণে (টিআই প্যারেড) পুলিশের বিলম্ব, শনাক্তকরণে যুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে উপস্থিত না হওয়া। শনাক্ত করলেও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় প্রধান সাক্ষী আসামিদের নাম বলতে না পারা এবং দণ্ডবিধির যে ধারায় অভিযোগ গঠিত হয়েছে, তা ঠিক না থাকা।

আদালতের এই রায়ের বিষয়ে কিছুই জানেন না ভুক্তভোগী রেবেকা নাসরিন। গত ২৬ এপ্রিল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ডাকাতির পর তখনকার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার তাঁদের বাসায় এসেছিলেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তেরও আশ্বাস দেন। এরপর একবার তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন আসামি শনাক্ত করতে। তিনি দুজনকে শনাক্তও করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অস্ত্র বা মালামাল কিছুই উদ্ধার হয়নি। আর রায়ের বিষয়েও পুলিশ তাঁকে কিছুই জানায়নি।

পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, ডাকাতির ঘটনায় হওয়া ৭৭ শতাংশ মামলাতেই আসামিরা খালাস পেয়ে যান। এর মধ্যে বৈরী সাক্ষীর কারণে খালাস হয় ৫০ শতাংশ, তদন্তে ত্রুটির কারণে ২২ শতাংশ, ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে ২ শতাংশ মামলার আসামিরা খালাস পান। আর বাদী, সাক্ষী, প্রসিকিউশন সক্রিয় থাকার পরও খালাস হয় ৩ শতাংশ মামলার আসামি।

২০১৬ সালে ২১টি জেলায় হওয়া ১২৬টি ডাকাতি মামলার রায় এবং ২০১৭ সালে ২৫টি জেলায় হওয়া ১২১ মামলার রায় পর্যালোচনা করে পিবিআই এই তথ্য তুলে ধরেছে। মামলাগুলো হয়েছে ১৯৮৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। এর মধ্যে মাত্র ছয়টি মামলায় সর্বোচ্চ সাজা (দুটিতে মৃত্যুদণ্ড, চারটিতে যাবজ্জীবন) হয়েছে। আর অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়েছে ৫০টি মামলায়।

পিবিআইয়ের প্রধান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান তদন্ত প্রক্রিয়ার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা জানার জন্য গবেষণাটি করা হয়েছে। মামলার রায়গুলো পর্যালোচনায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের তদন্তে গাফিলতি, বৈরী সাক্ষী এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা—এই বিষয়গুলো প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

মামলাই নেন না ওসিরা

ডাকাতির শিকার হওয়ার পর থানায় গেলে মামলাই নিতে চান না ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি)। তাঁরা ভুক্তভোগীদের অন্য ধারায় মামলা করতে বলেন। পিবিআই বলছে, এত কিছুর পরও যে সামান্য কিছু মামলা ডাকাতি হিসেবে নেওয়া হয়, তার খুব অল্পতেই পুলিশ আসামি শনাক্ত করতে পারে। ফলে বিচারকাজও শুরু হয় খুব কমসংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। আবার দীর্ঘ বিচারকাজ শেষে এসব ব্যক্তির খুব কমসংখ্যক দোষী সাব্যস্ত হন। আর দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বিচার শুরুর আগ থেকেই অথবা পরে জামিনে গিয়ে পলাতক থাকেন। পিবিআইয়ের গবেষণায় আমলে নেওয়া ২৪৭টি মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামির সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩২। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশই খালাস পেয়েছেন।

দীর্ঘদিন ওসির দায়িত্ব পালন করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পুলিশ সুপার মো. আরমান আলী। ডাকাতি মামলা নিতে ওসিদের অনিচ্ছার বিষয়ে তিনি বলেন, ডাকাতি মামলা হলেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই ভাবতে শুরু করেন, অপরাধ বেড়ে গেছে। কোনো থানায় তাই মাসে চার–পাঁচটি মামলা হলেই ওসি বিষয়টিকে তাঁর ‘ডিসক্রেডিট’ বলে ভাবতে শুরু করেন। তাই তাঁরা মামলা নিতে চান না।

বৈরী সাক্ষীর কারণে ৫০ শতাংশ মামলা খালাস

খালাস হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে অধিকাংশতে সাক্ষীরা ঠিকমতো সাক্ষ্য না দেওয়ায় আদালত আসামিদের খালাস দেন। পিবিআই বলছে, যে ১৯১টি মামলায় আসামি খালাস পেয়েছেন, তার মধ্যে ১২৫টিতেই সাক্ষী বৈরী ছিলেন। মামলায় রায় পর্যবেক্ষণ করে পিবিআই বলছে, আদালতে সাক্ষীর অনুপস্থিতি, এজাহারকারীসহ কোনো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত না হওয়া, সাক্ষীদের সাক্ষ্যে গরমিল, এজাহারকারী ও সাক্ষী কর্তৃক কাউকে শনাক্ত করতে না পারা, জব্দতালিকা অনুযায়ী সাক্ষীদের বক্তব্যের গরমিল, এজাহারকারী আসামিদের নাম জানার পরও তা উল্লেখ না করা—এসব কারণে অধিকাংশ মামলার আসামি খালাস পেয়ে যান।

দীর্ঘ ৩৬ বছর বিচারকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মূল বিষয় হচ্ছে ডাকাতি মামলা দায়েরের সময় পুলিশ যারতার নাম দিয়ে সাক্ষীর কলাম পূরণ করে দেয়, যাচাই করে না। এদের জিজ্ঞাসাবাদ না করে বক্তব্য নিজেরাই মনমতো লিখে দেয়। পরে আদালতে যখন সাক্ষীদের আসামির আইনজীবী জেরা করেন, তখন তাঁরা কিছুই বলতে পারেন না। ফলে আসামিরা খালাস পেয়ে যান।

তবে এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকা পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামালের মতে, সাক্ষী বৈরী হওয়ার পেছনে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা একটি বড় কারণ। দীর্ঘ সময় ধরে বিচার চলায় সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যাঁদের পাওয়া যায় তাঁরা সাক্ষ্য দিতে চান না। অনেক সাক্ষী ঘটনাই ভুলে যান।