
গানের কথা ও সুরে এত ভালোবাসা ও নিবেদন, বাস্তব জীবনে কি কাউকে বলা হয়নি সে রকম করে?
প্রশ্ন শুনে একটু থমকে গেলেন হৈমন্তী শুক্লা, তাঁর চেয়ে কম বয়সী একজনের মুখে এ রকম কথা শুনে একটু বিরক্তও হলেন বোধকরি। কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়েছেন। স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, ‘আসলে সেই কিশোরীবেলা থেকে গানেরই তো প্রেমে পড়ে আছি, অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় পাইনি। সে রকম করে কাউকে মনেও ধরেনি, তাই “আমার বলার কিছু ছিল না...” হা হা হা।’
এমন মন ভিজিয়ে দেওয়া গানের গলা, তার ওপর সুন্দরী, অনুরাগীর ভিড় তো ছিল চারপাশে..., তাদের কেউ এগিয়ে এসে বলেনি, ভালোবাসি?’
না, বলেনি তো (হাসি)। আসলে চারপাশে একটা বেড় তৈরি করে রেখেছিলাম বলেই হয়তো ভরসা পায়নি।
বিয়ে বা সংসার করলেন না, কেন?
এই কেনর তো কোনো উত্তর নেই। বাবা নিজে গাইয়ে ছিলেন, তাঁর হাত ধরে সেই শিশুবয়সে নিজের অজান্তে গানের জগতে প্রবেশ করেছি। বাবা চাইতেন না আমি বিয়ে করি, নিজের মধ্যেও কেন যেন সে রকম আগ্রহ তৈরি হয়নি। তবে সংসার করিনি কথাটা ঠিক নয়। পরিবারে আমি বোনদের মধ্যে সবার বড়। এখন তো বাবা-মা নেই, আমিই ভাইবোনদের কাছে মায়ের মতো, আমিই তাদের আশ্রয়। সেই অর্থে আমার সংসারটা অনেক বড়।
কিছু দিন আগে চিটাগং ইনস্টিটিউটের (সিনিয়রস ক্লাব) আমন্ত্রণে একটি অনুষ্ঠানে গাইতে এসেছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান দুই শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা ও সৈকত মিত্র। অনুষ্ঠান শুরুর আগে যখন রিহার্সেল করবেন বলে হৈমন্তী বসেছিলেন তাঁর যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে, তখন রিহার্সেলে বাগড়া দিয়ে প্রায় নাছোরবান্দা হয়ে নিয়েছিলাম প্রিয় শিল্পীর এই সাক্ষাৎকার।
গানের কথায় আসি। শুরুটা হয়েছিল কীভাবে?
ওই যে বললাম, প্রথম তালিম পেয়েছিলাম বাবার হাতে। ১৯৭২ সালে প্রথম শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে রেকর্ড করলাম ‘এ তো কান্না নয়’ গানটি। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর একে একে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘ওগো বৃষ্টি তুমি চোখের পাতা ছুঁয়ো না’, শ্যামল মিত্রের সুরে ‘এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি’, মান্না দের সুরে ‘আমার বলার কিছু ছিল না’।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করতে শুরু করলেন কখন থেকে?
প্রায় শুরু থেকেই। প্রথম দু–একটি গান রেকর্ড করার পর যখন শ্রোতারা গ্রহণ করলেন, তখন থেকেই চলচ্চিত্রে গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলাম। হিসাব করে সংখ্যা বলতে পারব না, তবে বহু ছবিতে গেয়েছি। হিন্দি ছবিতেও গেয়েছি বেশ কিছু। চশমে বদ্দুর নামে একটি ছবির গান তো এখনো লোকের মুখে মুখে ফিরছে।
মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তো অনেক বড়, সেখানে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো?
আসলে অনেকেই তখন মুম্বাইতে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি একা একটা মেয়ে... কীভাবে থাকি...।
শিল্পীজীবনের স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত...সে রকম তো অনেক আছে। যেমন ধরো, একদিন স্টেজে গান করার পর যখন গ্রিনরুমে ফিরলাম, খোদ্ মান্না দে বললেন, ‘তোমার গলাটা তো ভারি মিষ্টি’। ভাবো, আমি তখন নেহাৎ নবীন শিল্পী। আমি বললাম, আপনার সুরে গান গাইতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। আমাকে দিয়ে গাওয়ালেন, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’র মতো গান। তেমনি আমার গান শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন, ‘আমার সুরে গান করবে?’... এসব যে সেই বয়সে আমার জন্য কত বড় পাওয়া!
অন্য প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের শিল্পীদের গান শোনেন?
হ্যাঁ, শুনি তো। রুনা, সাবিনা ওঁদের কথা নতুন করে আর কী বলব, খুবই গুণী শিল্পী এঁরা। আর ভালো লাগে শাকিলা জাফর আর সুবীর নন্দীর গলা। বাংলাদেশের অনেক শিল্পীর সঙ্গেই আমার মধুর সম্পর্ক। তা ছাড়া, এ দেশের অনেকের সুরে আমি গেয়েছি। যেমন শেখ সাদী খান, সুজেয় শ্যাম, আসফউদ দৌলা- এঁরা আমাকে দিয়ে গাইয়েছেন। শেখ সাদীর সুরে ‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি’গানটি গেয়ে আমি তো এখানে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। আমি বাংলাদেশে প্রথমবার এসেছিলাম কিন্তু পুরস্কার জয়ী হিসেবে (হাসি)।
চট্টগ্রাম কি এই প্রথম এলেন?
না, এটা আমার এখানে দ্বিতীয়বার আসা। ভারি সুন্দর শহর। এয়ারপোর্ট থেকে নদীর ধার দিয়ে আসার পথে চোখ জুড়িয়ে গেল। মানুষও খুব ভালো এখানকার। আবার আসতে চাই, তবে বয়স হয়েছে তো পারব কিনা জানি না।
পারবেন। নিশ্চয় পারবেন। ভালোবাসার টানে আবার আসতে হবে আপনাকে, গানে ভরিয়ে দিতে হবে শ্রোতার হৃদয়।