ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। তবে এ যুক্তি দেখিয়ে অপরাধ দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ‘ক্রসফায়ার’ সুদূর ভবিষ্যতে কী পরিণাম বয়ে আনবে, তা ভেবে দেখার কথা বলেছেন অনেকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী সিনেট ভবনে ‘অপরাধ ও সংঘাতের পরিবর্তিত ধারা: বাংলাদেশে অপরাধতত্ত্বের ভূমিকা’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠকে ২২ জন বক্তব্য দেন। এঁদের মধ্যে পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, সিআইডি, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, অপরাধ নিয়ে কাজের সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, সেনাবাহিনী ও পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদেরাও রয়েছেন। আলোচনায় সঞ্চালক ছিলেন অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান।
আলোচকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বক্তা পুলিশের তদন্তের দুর্বলতা, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা ও ‘ক্রসফায়ার’কে সমালোচনা করেছেন। অনেকগুলো আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই বলেও উল্লেখ করেছেন তাঁরা। আবার পুলিশ-র্যাবের কর্মকর্তারা বিষয়গুলো খণ্ডনের চেষ্টাও করেছেন।
মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, তদন্ত ঠিকমতো হচ্ছে না বলেই আদালত থেকে জঙ্গিরা জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসছে। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে রক্তাক্ত হামলার পরে বিচার হয়েছে। এক হামলাকারীর রায়ও কার্যকর হয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনার বিচার শেষ হয়নি।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেন, বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘নতুন নতুন অপরাধ দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক কিছুতে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা সব ক্ষেত্রে শর্টকাট উপায় নিচ্ছি। একদিন না একদিন এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’
আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, ‘আমাদের চমৎকার একটা সন্ত্রাসবিরোধী আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই।’ ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে তিনি সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অপরাধের নতুন ধরনে গুম, ক্রসফায়ারের মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যুক্ত হয়েছে। ভদ্রবেশী অপরাধ, সমন্বিত অপরাধের মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ছাড়া বন্ধ করা যাবে না। শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিলেন কয়েকজন, তাঁদের শনাক্ত করা হলো। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিল না। আমাদের অনেক আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা অপরাধ দমনে সহায়ক হচ্ছে কি না, ভাবতে হবে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে গত ১৫ বছরে অপরাধ কমেছে কি না, তা দেখতে হবে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘জলদস্যু, অপহরণকারী, খুনি ইত্যাদি অপরাধীদের বিভিন্ন ধরন নিয়ে যখন আমাদের কাজ করতে হবে, তখন আমরা অনেক কথাই গোপন রাখব, বলব না। আমাদের ব্যর্থতা আছে। আবার যখনই কোনো র্যাব সদস্য অপরাধে জড়িয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে র্যাবের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় সব সময়। কিন্তু হত্যা কেউ পছন্দ করে না। আমরাও মানুষ।’ তিনি বলেন, জঙ্গিরা এ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যদি তাদের সঠিক ও শক্তভাবে দমন করা না হয়।
এ সময় আইনজীবী তানিয়া আমীর প্রশ্ন করেন, সঠিক পন্থাটা কী? কর্নেল জিয়া উত্তর দেন, ‘জাস্টিস সিস্টেম’। বিচারব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার কোনো নারীকে আদালতে বলতে হয় তিনি কীভাবে ধর্ষণের শিকার হলেন। এটা শোনার জন্যই মনে হয় আদালতকক্ষে লোকজন গিয়ে বসে থাকে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার উল্লেখ করে বলেন, ২০০০ সালের দিকে তিনি যেসব মামলার তদন্ত করেছিলেন, সেগুলোর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এখন তাঁকে ডাকা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সাইবার টেররিজম বলে যে বিষয়টা এসেছে, তা ৫০ ভাগ বন্ধ করা যাবে, যদি মুঠোফোনের সিম নিবন্ধন নিশ্চিত করা যায়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, এখন সাক্ষী নির্ভরতা কমিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তে জোর দিতে হবে। ২০০ টাকাতেও এ দেশে সাক্ষী পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, রাষ্ট্রের আইন সেবা থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসন সর্বত্রই একটা রাজনৈতিক পক্ষপাত রয়েছে।
ব্লগার প্রসঙ্গ: র্যাবের কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ব্লগাররা ধর্ম নিয়ে কী লিখছেন, তাও দেখতে হবে। এসব লেখা জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে কি না, তা ভাবতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মনিরুল ইসলামও বলেন, দু-একজন যা লিখছেন তা আসলে কার পক্ষে যাচ্ছে, তা ভাবতে হবে। এঁদের লেখার কারণে ব্লগারদের সারা দেশে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে একটি পক্ষ। এতে কারা লাভবান হচ্ছে, তা ভাবতে হবে।
রাজনৈতিক সন্ত্রাস: বিজিবির কর্নেল তৌহিদুল ইসলাম বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সাধারণ মানুষের ওপরে, যানবাহনে হামলা হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম প্রাণঘাতী হামলার প্রবণতা দেখা গেছে।
তানিয়া আমীর বলেন, যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বলে খাটো করবেন না। এটি একটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ।
যুগ্ম কমিশনার মনিরুল বলেন, আন্দোলনের নামে যে জ্বালাও-পোড়াও হলো, এর মধ্যে সন্ত্রাসবাদের সব উপকরণ রয়েছে। তবে কয়েকটি মাত্র মামলা সন্ত্রাস দমন আইনে করা সম্ভব হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, সরকার বদলের সঙ্গে অপরাধের সংজ্ঞা ও অপরাধীরা যেন পরিচয় পাল্টাতে না পারে, সে বিষয়টি দেখতে হবে। এক আমলে একজন অপরাধী, আরেক আমলে অপরাধী নয়—এ রকম যেন না হয়।
মানব পাচার: বিজিবির কর্নেল তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মানব ও মাদক পাচারের ক্ষেত্রে শুধু বাহকদের ধরা হচ্ছে। যারা অর্থায়ন করছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তিনি বলেন, কেন এত মানুষ এত ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাচ্ছে, তার প্রেক্ষাপট বিচার করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ (জি টু জি) ব্যর্থ হয়েছে। বৈধ অন্য কোনো উপায়ে মানুষ যেতে পারছে না। আবার সেখানে কাজের বাজার থাকায় মানুষ অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছে।
প্রায় পৌনে চার ঘণ্টার গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের পরিচালক (বহির্বিভাগ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুল আলম, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌহিদুল ইসলাম, কোস্টগার্ডের অতিরিক্ত পরিচালক কমোডর ইয়াহিয়া সাঈদ, একাত্তর টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের প্রভাষক অনুরাগ চাকমা, আওয়ামী লীগের নেতা এ কে ফাইয়াজুল হক, রাশেক রহমান প্রমুখ।