জুলাই গণ–অভ্যুত্থান কেবল একটি ছাত্র আন্দোলন ছিল না, ছিল আমজনতারও আন্দোলন। জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্দোলনটি সবার হয়ে ওঠে; কিন্তু যে স্বপ্ন সামনে রেখে আমজনতা রাস্তায় নেমেছিলেন, এখনকার সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে কি তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে?
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়ে তোলা, যেখানে জাতি, ধর্ম, শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্য এবং আধিপত্যবাদ থাকবে না। দেশের উন্নয়নে সব নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। দুঃখজনক হলো, গত এক বছরে সে প্রত্যাশার অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে শুরু করেছে। সারা দেশে চাঁদাবাজি, মবতন্ত্র, নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণ ও অবমাননা, আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণ এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন, তকমা দেওয়া ইত্যাদি বেড়ে গেছে। স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসনকে হটিয়ে মানুষ এ রকম মবতন্ত্রের দেশ চায়নি। জুলাইয়ের উত্তাল সময়ে গুলির মুখে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষ যখন রাজপথে নেমে এসেছিলেন, তখন তাঁরা নিশ্চয়ই এমন দায়হীন ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রত্যাশা করেননি।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে অনেক সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এক সরকার গেছে, আরেক সরকার ক্ষমতায় এসেছে; কিন্তু সরকারগুলোর ফ্যাসিবাদী চরিত্র বা পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়, তখন আমরা আশা করেছিলাম, এবার বুঝি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু হলো। সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। এখন সেসব সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার করার দায়িত্ব সরকারের; ভবিষ্যতে যেসব রাজনৈতিক দল দেশ পরিচালনা করবে, তাদের।
আমরা বিশ্বাস করি, দেশের সব শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণই গণতন্ত্রের মূল শর্ত। তাই ফ্যাসিবাদী বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য আমরা জুলাই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম। রাজপথের স্লোগানে-বক্তৃতায় যতবার ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ’-এর শব্দটি শুনেছি, ততবারই উচ্ছ্বসিত হয়েছি। মনে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছিল, এবার তাহলে সত্যিকার অর্থে এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের ওপর জিইয়ে থাকা দীর্ঘদিনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও জুলুম থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন; কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টের পরে যতই দিন পেরিয়ে মাস গড়িয়েছে, ততই সেই উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
অভ্যুত্থানের মাত্র দেড় মাসের মাথায় পাহাড় আবার জ্বলে উঠল। আমাদের সন্তানের রক্তে আবারও রঞ্জিত হলো রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির মাটি। পাহাড়বাসীরা বর্তমান সরকারের কাছে এ ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার আশা করেছিল; কিন্তু পাহাড়ে ‘বিচারব্যবস্থা’ সব সময় নিভৃতে কেঁদে চলে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরে সারা দেশ পরিবর্তনের হাওয়ায় ভেসে গেলেও পাহাড়ে কিন্তু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসন বহাল তবিয়তে রয়ে যায়।
এ ছাড়া শাসকশ্রেণির মনোজগতের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেনি, সেটি আরও প্রকটভাবে চোখে পড়ে অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আঁকা একটি ঘটনায়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময়ে একটি গ্রাফিতি দেশের বিভিন্ন জায়গার দেয়ালে আঁকা ছিল। গ্রাফিতিটি ছিল একটি গাছের, যার পাঁচটি পাতায় লেখা ছিল—বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিষ্টান। পাশে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। গ্রাফিতিটি নতুন পাঠ্যবইয়ে সংযোজন করার পর একটি মহল এনসিটিবি ভবনে ঢুকে ত্রাস তৈরি করে। তারা গ্রাফিতিটির চিত্র পাঠ্যবই থেকে বাতিলের দাবি তোলে। রাতের মধ্যে গ্রাফিতিটি পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতা এনসিটিবি অভিমুখে মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে পুলিশের উপস্থিতিতে তাঁদের ওপর বর্বরোচিত হামলা করা হয়। অথচ আদিবাসী শিক্ষার্থীদের অনেকেই গোটা জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এ ঘটনা কি ইঙ্গিত করে না যে বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা মুখে বলা হচ্ছে বটে; কিন্তু শর্ষের মধ্যেই ভূত আছে!
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা বহুত্ববাদের কথা বলছি, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা ভাবছি; কিন্তু এগুলো মুখের কথায় সীমাবদ্ধ থাকলে তো হবে না, অন্তরে ধারণ করে এর বিকাশ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ একটি বিচিত্র জাতি, বিচিত্র সংস্কৃতি, বিচিত্র ভাষার দেশ। এই বহুত্ববাদের বৈচিত্র্যের কথা ভুলে গিয়ে কেবল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ’–এর বুলি আওড়িয়ে জুলাই গণ–আন্দোলনের মর্ম বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
বহু নেতিবাচক ঘটনার পরেও আমরা কিছু আশা নিয়ে বেঁচে থাকি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সহিংসতার পরে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় আগুনে পুড়ে যাওয়া লারমা স্কয়ার বাজার পরিদর্শনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্কালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পাহাড়ে নানা বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আমরা লড়াই–সংগ্রাম করে যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, সেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সকলের সহযোগিতা নিয়ে বৈষম্যহীন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই।’ এ বছরের জুলাই মাসে এনসিপির পদযাত্রার অংশ হিসেবে রাঙামাটি গিয়ে নাহিদ ইসলাম আবারও বলেন, ‘সব বিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে সব জনগোষ্ঠীকে মর্যাদা দিয়ে একটি সংবিধান তৈরি করতে চাই।’ এনসিপির পক্ষ থেকে এ–ও বলা হয় যে সংবিধানে বিচিত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি না দিয়ে সবাইকে যে জোর করে বাঙালি করা হয়েছিল, তারা সেটি দূর করতে চায়। এগুলো যেন কথার কথা না হয়।
আমরা বিশ্বাস করি, তরুণ প্রজন্ম অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশের স্বপ্নকে লালন করে। তাঁদের সেই স্বপ্ন কচি হাতের লেখায় দেশব্যাপী দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠেছিল। কতিপয় বর্ণচোরা গোষ্ঠী যাতে সেই স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত করে দিতে না পারে, সেদিকে সবার চোখ রাখতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী; সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন