ঘটনাস্থল থেকে একজনের মরদেহ নিয়ে যাচ্ছে উদ্ধারকারী দল
ঘটনাস্থল থেকে একজনের মরদেহ নিয়ে যাচ্ছে উদ্ধারকারী দল

স্বজনদের কান্না, অপেক্ষা

বেলা পৌনে তিনটা। উত্তরা উত্তর মেট্রোরেল স্টেশন থেকে দিয়াবাড়ী গোলচত্বর পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ। তাই মেট্রো থেকে নেমে কেউ দৌড়াচ্ছেন, কেউ দ্রুত হাঁটছেন। তাঁদের গন্তব্য গোলচত্বরের পাশে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেখানে একটি ভবনে বেলা একটার পর বিধ্বস্ত হয়েছে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান।

গোলচত্বরে গিয়ে দেখা যায়, চত্বরসহ আশপাশে হাজারো মানুষের ভিড়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অভিভাবক, স্বজন। সবার চোখে–মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। তাঁদের অনেকে মুঠোফোনে পরিবারের অন্য সদস্য বা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছেন। কারও মুখে স্বস্তির খবর, কেউ বা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, সন্তানকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ স্কুলের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

নিরাপত্তাকর্মীরা বারবার সবাইকে শান্ত থাকার ও সহায়তা করার আহ্বান জানাচ্ছেন। বলছেন, আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং অন্য শিক্ষার্থীরা নিরাপদে আছে।

একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতর ঢুকছে, বের হচ্ছে। মাইলস্টোনসহ আশপাশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এক অপরের হাত ধরে রাস্তা ফাঁকা রেখেছে, যাতে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি বাহন নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে। ওই শিক্ষার্থীদের একজন একাদশ শ্রেণির ছাত্র কাব্য। সে জানায়, বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যায়। তখন স্কুলের মাঠে অনেক শিক্ষার্থী ছিল।

মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সন্তানের খোঁজে এক মা। সোমবার বিকেলের চিত্র

বেলা সাড়ে তিনটা। মেয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকা মধ্যবয়সী এক নারী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আল্লাহ, তুমি আমার মেয়েটারে ফিরায়া দাও।’ পাশে দাঁড়ানো এক স্বজন জানান, তাঁর মেয়ে সুমাইয়া চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছুটির পর মেয়েকে নিতে স্কুলের ফটকে অপেক্ষা করছিলেন। এর মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। এখনো মেয়ের খোঁজ পাননি। ভেতরে মেয়ের বাবা মেয়েকে খুঁজতে গেছেন।

এ সময় সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা মাইকে ঘোষণা দেন, আহতদের জন্য রক্তের প্রয়োজন। বিশেষ করে যাঁদের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ, তাঁদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করা হয়। অনেকেই সাড়া দিয়ে এগিয়ে যান। পরে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে করে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর উদ্ধার তৎপরতা চালান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা

উদ্ধার তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি বাইরের ভিড় সামলাতেও বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ঘটনাস্থলের দিকে দলে দলে হেঁটে আসছেন মানুষ। হঠাৎ একজন অভিভাবক নিরাপত্তাবেষ্টনী ডিঙিয়ে স্কুলের ভেতরে যেতে চান। নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে বাধা দেন। এ সময় কান্নাজড়ানো এই অভিভাবক বলেন, তাঁর ছেলে জিহান মাইলস্টোনের হোস্টেলে থাকে, এখনো খোঁজ পাননি। অনেক অনুরোধের পর তাঁকে প্রধান ফটক পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়।

সোয়া চারটার দিকে কথা হয় ফজলুর রহমান নামের ওই অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে জিহান অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আমরা সাভারে থাকি, তাই তাকে হোস্টেলে রেখেছি। এখন পর্যন্ত কোনো খবর পাইনি।’

বেলা সাড়ে ৪টা, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সামনেও হাজারো মানুষের ভিড়। সাইরেন বাজিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ভেতরে ঢুকছে। মানববেষ্টনী করে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের জন্য রাস্তার ফাঁকা করে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। দগ্ধ শিক্ষার্থীদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। হাসপাতালের বাইরের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু আহতদের ও তাদের স্বজনদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালের সামনে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকেরা হাসপাতালের সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছেন। তারা আহত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের খুঁজতে সাহায্য করছেন। শিক্ষার্থীদের নাম ধরে মাইকে বলা হচ্ছে তাদের কোনো অভিভাবক আছেন কি না। আবার কাগজেও শিক্ষার্থীর নাম লিখে উঁচিয়ে ধরা হচ্ছে, যাতে তার অভিভাবক দেখতে পান। রক্তের প্রয়োজনেও মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। রক্তদাতারাও কাগজে লিখে সেটি উচিয়ে ধরে তাঁদের আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন।

জরুরি বিভাগের সামনে অনেক উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও স্বজন। একটু পর পর জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসকসহ মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা বাইরে এসে শিক্ষার্থীদের নাম ধরে অভিভাবকের খোঁজ করছেন। সাড়া মিললে তাদের শিক্ষার্থীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কেউ কেউ সন্তানকে অন্য হাসপাতালে বা বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর আহত এক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। সোমবার দুপুরের চিত্র

প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় ফেরার সময় শিক্ষার্থী সূর্য সময় বিশ্বাসের চাচাতো ভাই প্রগতি বিশ্বাস জানান, ছেলে সূর্যকে আনতে তার বাবা মুকুল বিশ্বাস স্কুলে যান। ছেলেকে তার কাছে ফেরার আগেই বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে দুজনই আহত হন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সূর্যকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে মুকুল বিশ্বাস হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে ‎উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাক্তার এ এস এম রাকিবুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালটিতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৬০ জনের মতো চিকিৎসা নিয়েছেন। বেশির ভাগের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছর। এর মধ্যে ৪০-৪৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের বেশির ভাগেরই শরীর ৬০-৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। আহতদের মধ্যে ২৩ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ‎দুজন মারা গেছে। একজনের বয়স ১৪ বছর, আরেকজনের বয়স ২০ বছর। তাৎক্ষণিকভাবে মৃতদের নাম–পরিচয় জানা যায়নি।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উত্তরার লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রোগীদের তেমন ভিড় নেই। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক রক্তের জন্য মাইকিং করছেন। জরুরি বিভাগে দেখা গেল, উমায়ের নামে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ রাখা। শিশুটির বয়স ১১ বছর। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন। নিহতের স্বজনেরা জানান, শিশুটির শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায়। হাসপাতালে আনার পর তাকে মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসক। এখন তারা বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।

লুবানা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মো. মেহেদী হাসান জানালেন, সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ১৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। যার মধ্যে ১২ জনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭ থেকে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, শরীরের ৬০-৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর একজন মারা গেছে।

এ ছাড়া একই হাসপাতালের আরেক ভবনে ৫ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। আরাফাত গাজী নামের একজন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে। তার ডান হাতের কিছু অংশ পুড়ে গেছে।