
বিরল ও দুর্লভ জলচর পাখিদের প্রজনন প্রতিবেশসংক্রান্ত গবেষণার জন্য রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রাজশাহীর পদ্মায় কাজ সেরে কুষ্টিয়ায় এসেছি। কুষ্টিয়ার স্থানীয় আলোকচিত্রী কিরণ খানকে সঙ্গে নিয়ে শহর থেকে খানিকটা দূরের তালবাড়ি এলাম। মাঝির বাড়ি তালবাড়ি ঘাটের কাছেই। নৌকা ছাড়ার আগেই পদ্মার পাড়ে প্রচুর গাঙশালিকের দেখা পেলাম। ওদের কয়েকটি শট নেওয়া হলেই মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলেন। প্রায় ৩৫ মিনিট পর আমরা নদীর অন্য পাড়ের চরে পৌঁছে গেলাম।
নৌকা থেকে নেমে নদীর টলটলে পানিতে কিছুক্ষণ হেঁটে চরে উঠলাম। পানির শীতলতায় দেহ-মন জুড়িয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক পরেই এক জোড়া আদুরে পাখি বাবুই বাটানের দেখা পেলাম। ওদের ছবি তোলা নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত হতেই মাথায় কালো টুপি পরা ধূসরাভ সাদা এক জোড়া পাখির সঙ্গে দেখা হলো। পাখি দুটির মধ্যে বেশ ভাব লক্ষ করলাম। একটি পাখি মুখে মাছ নিয়ে তার সঙ্গীকে খাওয়াচ্ছে। দেখেই বুঝলাম, কী হচ্ছে। তবে এই দৃশ্যের ছবি ধারণ করতে ব্যর্থ হলাম। কী অদ্ভুত ভালোবাসা? সত্যিই চমৎকার। যে পাখিটি মুখে মাছ নিয়ে খাওয়াল, সে হলো পুরুষ, অন্যটি স্ত্রী। পরবর্তী সময়ে রাজশাহীর পদ্মার চরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম।
সাদা-কালো-ধূসর বর্ণের জলজ পাখি দুটির দেহ ছিপছিপে, ডানা চোখা ও লেজের মাঝখানটা চেরা। দেহের ওপরের অংশ ধূসরাভ সাদা ও নিচের অংশ পুরোপুরি সাদা। মাথা কালো ও কপাল সাদা। উড়ন্ত অবস্থায় ডানার বাইরের কালচে প্রান্তপালক ও সাদা কোমর চোখে পড়ে। প্রজনন মৌসুমে চোখের ওপর ছোট ভ্রু দেখা যায়। চোখের রং বাদামি। চঞ্চুর রং হয় হলদে, যার আগা কালো, পা হয় কমলা। প্রজননহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথার সামনের অংশ সাদা এবং চঞ্চু ও পা থাকে কালো। স্ত্রী ও পুরুষের চেহারায় কোনো পার্থক্য নেই। ছোট আকার এবং সরু ও চোখা চঞ্চুর মাধ্যমে দরিয়ার চিল থেকে ওদের আলাদা করা যায়। ওদের দেহের দৈর্ঘ্য ২০-২৮ সেন্টিমিটার।
জলজ পাখিগুলো দেশব্যাপী উপকূল, নদী, চরাঞ্চল, জলাভূমি, হ্রদ, বাঁধ ইত্যাদিতে ছোট ছোট বা মাঝারি ঝাঁকে বিচরণ করে। ওরা দিবাচর, জলচর, ভূচারী ও আকাশচারী পাখি। অগভীর পানির ওপর দিয়ে উড়ে পানিতে চলমান বা ভাসমান মাছ, কাঁকড়া ও জলজ কীটপতঙ্গ টার্গেট করে হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে ধরে খায়। খাবারের জন্য জেলে নৌকার পিছু নিতে ছাড়ে না। বারবার ‘কিরিক-কিরিক’ শব্দে ডাকতে থাকে।
মে থেকে জুন ওদের প্রজননকাল। এ সময় বালুকাবেলায় সামান্য গর্তমতো করে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ১-৩। রং বালুর মতো বাদামি, তার ওপর থাকে কালচে বা লালচে ছিটছোপ। স্ত্রী-পুরুষ পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৭-২২ দিনে। মা-বাবা মিলেমিশে ছানাদের যত্নœকরে। ছোট ছোট মাছ ধরে খাওয়ায়। ছানারা ১৭-২২ দিন বয়সে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১১ বছর।
কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর পদ্মার চরে দেখা প্রেমময় পাখি দুটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি খুদে বা ছোট গাঙচিল। ইংরেজি নাম লিটল টার্ন। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Sternula albifrons। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।