চট্টগ্রাম ওয়াসা: প্রকল্পে ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা, এখন গ্রাহক পাচ্ছে না

চট্টগ্রাম নগর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ভান্ডাল জুড়ি পাহাড়ের পাদদেশে এ প্রকল্পের পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে ১৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের চার উপজেলায় পানি সরবরাহ করতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। পাঁচ বছরের কাজ শেষ করতে সময় নিয়েছে প্রায় এক দশক। ব্যয় বেড়েছে ৯৫৮ কোটি টাকা। বাড়তি সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির পরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গ্রাহক পাচ্ছে না সংস্থাটি। এতে বিপুল বিনিয়োগের সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চট্টগ্রাম নগর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকার ভান্ডাল জুড়ি পাহাড়ের পাদদেশে এ প্রকল্পের পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে ১৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।

তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও শিল্পকারখানার মালিকেরা পানির সংযোগ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। চাহিদা না থাকার পরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ওয়াসা। অথচ পানিসংকটে থাকা চট্টগ্রাম নগরের বড় অংশে সংযোগ দিতে পারছে না এই সংস্থা। দিনের পর দিন পানি নিয়ে দুর্ভোগে আছেন অন্তত ১৫ লাখ বাসিন্দা। 

২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ করার কথা ছিল; কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয় ওয়াসা। পরে প্রকল্পের ব্যয় ৯৫৮ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ৯২ শতাংশ। 

প্রকল্পের মোট খরচ হওয়া টাকার মধ্যে কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের ‘ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড’ দেয় ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। ওয়াসা দেয় ২০ কোটি। বাকি ৭৫০ কোটি টাকা দেয় সরকার, অর্থাৎ যা আসে জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকা থেকে। 

কেন গ্রাহক পাচ্ছে না

এ বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তবে এর মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। অবশ্য কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের শুরুর দিকে আবাসিক ও শিল্পকারখানার গ্রাহকদের পানি সরবরাহে সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু করে ওয়াসা। এ প্রকল্পের আওতায় ১৫ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে; কিন্তু সংযোগপ্রক্রিয়া শুরু করার আড়াই বছরে গ্রাহক পেয়েছে তিন হাজার, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২০ শতাংশ। এর মধ্যে সংযোগ নিয়েছে এমন শিল্পকারখানার সংখ্যা মাত্র একটি।  

স্থানীয় মানুষ কেন ওয়াসার পানির সংযোগ নিচ্ছে না, তার কারণ উঠে এসেছে সংস্থাটির ২০২৩ সালে করা এক জরিপে। জরিপে বলা হয়, উপজেলার বাসিন্দারা টাকার বিনিময়ে পানির সংযোগ নিতে আগ্রহী নন।  কারণ, তাঁরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া গ্রামীণ গভীর নলকূপের পানি বিনা মূল্যে ব্যবহার করে থাকেন। 

সংযোগ নেননি এমন একজন পটিয়া পৌরসভার মুন্সেফ বাজারের শাহজালাল আবাসিক এলাকার মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, বাড়িতে আগে থেকেই গভীর নলকূপ রয়েছে। এ কারণে তিনি পানির সংযোগ নিচ্ছেন না। 

তবে পানির সংযোগ নেওয়া গ্রাহকেরা নিয়মিত পানি পাচ্ছেন বলে জানান। আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পটিয়ায় ৬০ লাখ লিটার, বোয়ালখালীতে ২০ লাখ লিটার, আনোয়ারায় ২০ লাখ লিটার, কর্ণফুলী উপজেলায় ৬০ লাখ লিটার করে প্রতিদিন পানি সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল। 

শিল্পপ্রতিষ্ঠানই মূল গ্রাহক

প্রকল্প শুরুর আগে ওয়াসা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করেছিল। নির্মাণকাজ শেষে দিনে ছয় কোটি লিটার পানি উৎপাদিত হওয়ার কথা। বর্তমানে দিনে ২০ থেকে ২৫ লাখ লিটার পানি উৎপাদিত হয় বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।  

দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, আনোয়ারা ও পটিয়া উপজেলায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) রয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরও অবস্থান। প্রকল্পের মূল লক্ষ্যও ছিল শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পানি সরবরাহ করা; কিন্তু পানির সংযোগ নিয়েছে শুধু চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল)। 

পানি নেওয়ার বিষয়ে সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দিনে তাঁদের দুই কোটি লিটার পানি দরকার হয়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এক হাজার লিটার পানির জন্য খরচ পড়ছে ২০ টাকার মতো। অন্যদিকে ওয়াসা থেকে পানি নিলে খরচ পড়বে ৩৭ টাকা। ফলে তাঁদের খরচ বেড়ে যাবে। তাই সংযোগ নিলেও পুরোপুরি ব্যবহার করছেন না। 

‘বিকল্প চিন্তা করতে হবে’

স্থানীয় বাসিন্দা ও শিল্পকারখানাগুলো পানির সংযোগ দিতে না পারার দায় নিচ্ছে না ওয়াসা; বরং গ্রাহকদের ওপর দায় চাপাচ্ছে। ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানির সংযোগ আমার বা আমাদের কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে না। আমরা পানি দিতে প্রস্তুত অথচ ওরা (শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক গ্রাহক) পানি নিচ্ছে না। গড়িমসি করছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, পটিয়া ও বোয়ালখালীতে স্থাপিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভূগর্ভস্থ পানি তুলছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।’ 

প্রকল্প বাস্তবায়নে মানুষের চাহিদা ও ওয়াসার পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় প্রকল্প নেওয়ার আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করার প্রয়োজন ছিল। কাজ শেষ হওয়ার পরেও গ্রাহক না পাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। এখন উপজেলায় গ্রাহক না পেলে উৎপাদিত পানি শহরে দেওয়ার ব্যবস্থা করার বিকল্প চিন্তা করতে হবে।