উদ্যোগ

সীতা লাউ ও অনন্য এক কৃষি উদ্যোক্তা

খাগড়াছড়ির মহালছড়ির ধুমনীঘাট গ্রামে ড্রাগন ফলের বাগান
ছবি: লেখক

সাজেক থেকে খাগড়াছড়ির শ্বাসরুদ্ধকর পথের দুপাশে মনোমুদ্ধকর শোভায় অবগাহন করতে করতে দুপুর ঘনিয়ে এলো। কোথাও কোথাও গাড়ির গতি রোলারকোস্টারের মতো; শাঁই করে নেমে যাচ্ছে, আবার খাড়া ঢাল বেয়ে ওপরে উঠছে। এদিকটায় পাহাড়ের উদ্ভিদবৈচিত্র্য এখনো আশাব্যঞ্জক। দুপুরে খাবারের জন্য খাগড়াছড়ি শহরে থামতে হলো।

বেলা তিনটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মহালছড়ির চব্বিশ মাইল। সেখানে অপেক্ষা করছেন কৃষি উদ্যোক্তা হ্লাশিং মং চৌধুরী। তাঁর বাগান দেখতে যাব। সহযাত্রীদের আগ্রহ বাগান দেখার, আমি যাচ্ছি সীতালাউ দেখতে। সময় কম তাই সুগন্ধি ও সুস্বাদু মারমা পিঠা পুঁটুলি বেঁধে সঙ্গে নেওয়া হলো। গাড়ি ছুটল বাগানের পথে, কাঁটামুড়ার ধুমনীঘাট গ্রামের দিকে।

খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার ধুমনীঘাট গ্রামের যাতায়াতব্যবস্থা কিছু দিন আগেও বেহাল ছিল। কিন্তু এসব প্রতিকূলতা মোটেও বড় বাধা হয়ে ওঠেনি কৃষি উদ্যোক্তা হ্লাশিং মং চৌধুরীর কাছে। এই উদ্যোগে স্ত্রী উনুচিং মারমাও সব সময় তাঁর সঙ্গে আছেন। সমৃদ্ধ বাগানটির বর্তমান চেহারায় তাঁদের কর্মনিষ্ঠা ও একাগ্রতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

খাগড়াছড়ির মহালছড়ির ধুমনীঘাট গ্রামে মং চৌধুরীর বাগানে সীতা লাউ

বাগানে যাওয়ার আগেই পথের ধারের বীথিবদ্ধ লেবুগাছগুলো মনে প্রশান্তি জাগাবে। পাহাড়ের অনুচ্চ ঢালজুড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ড্রাগন ফল চাষ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিচালিত ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের’ অধীনে ২০১৮ সালে এখানে ৪৫০টি ড্রাগনগাছের প্রদর্শনী বাগান সৃজন করা হয়। প্রথম বছরেই তিনি এই বাগান থেকে ড্রাগন ফল বিক্রি করতে সক্ষম হন। বর্তমানে তাঁর এই বাগান ‘ক্রা এ্এ এগ্রো ফার্ম’ নামে পরিচিত।

ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার সময় পরিপুষ্ট ড্রাগনগাছের বীথিবদ্ধ সুদৃশ্য বাগান দেখে মুগ্ধ হলাম। চূড়ায় উঠে পেলাম টংঘর। তার চালায় ঝুলছে কয়েকটি সীতা লাউ। পাহাড়ে এই সবজির চাষ প্রায় এক যুগ আগে শুরু হয়েছে। এই জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) একদল গবেষক। লাউটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একবার রোপণ করার পর টানা ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ফলন দিতে থাকে। সীতা লাউ গড়নের দিক থেকে খাটো ও মোটা। চারা লাগানোর পাঁচ থেকে ছয় মাস পর ফুল আসে। ৩০ দিন পর ফল সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী হয়। ৫ থেকে ৭ বছর বয়সী একটি গাছ থেকে প্রায় ২০০ লাউ পাওয়া যায়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে প্রায় সারা বছরই এ ফল চাষ করা যায়।

আত্মপ্রত্যয়ী উদ্যোক্তা মং চৌধুরী শুনিয়েছেন তাঁর বাগান তৈরির গল্প, সংগ্রাম ও স্বপ্নের কথা। ২০১৭ সালে তিনি একই প্রকল্পের অধীনে প্রায় ২০ জাতের প্রথম প্রদর্শনী আমবাগান তৈরি করেন। কিন্তু প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা স্বল্পসংখ্যক জাতের আম তাঁর মন ভরাতে পারে না। বৃক্ষমেলাসহ দেশের নানান প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করেন অনেক জাতের আমগাছ। বর্তমানে মৌসুমি–অমৌসুমি মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ৮৫ জাতের আমের গাছ। এসব আমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বারি-১১, দোকমাই, পালমার, রানিপসন্দ, সূর্যডিম, গৌরমতী, আলফানসো, রুবি, মাহাথির, বাউ-১৪, আফ্রিকান কিং, সুইটবল ইত্যাদি।

অন্যান্য ফলের মধ্যে পাঁচ রকম লিচু, চার জাতের কমলা ও মাল্টা, পাঁচ রকম পেয়ারা, আট জাতের কলা, তিন জাতের আমড়া, পাঁচ রকম জামরুল, তিন রকম সফেদা, তিন জাতের বাতাবিলেবু, আমলকী, তুঁতফল, করমচা, রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, ব্রেডফ্রুট, আলুবোখারা, পিচ, লংগ্যান, সীতা লাউ, সাতকরা, তৈকর, জাবাটিকাবা, লটকনসহ বিভিন্ন জাতের পেঁপে। এ ছাড়া আছে রাম্বুটান, লংগ্যান, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, টক আতা, জাবাটিকাব, সীতালাউসহ অনেক রকমের ফল, দারুচিনি, গোলমরিচ ও তেজপাতা। মোট ২৫ একরের এই বাগানে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি প্রচলিত ও অপ্রচলিত মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার উদ্ভিদের অনন্য সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন তিনি।

পাহাড়ে ফল চাষে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সেচ। সেই বাধা অতিক্রম করে বিকল্প পদ্ধতিতে ঝরনার পানি কাজে লাগিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে বৈশ্বিক যে সূচকে পৌঁছেছে, তাতে হ্লাশিং মং চৌধুরীর মতো অনেক উদ্যমী উদ্যোক্তার ভূমিকা রয়েছে। সারা বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশের যে সপ্তম অবস্থান, তাতেও এমন ছোট উদ্যোগগুলোর প্রত্যক্ষ অবদান আছে। আছে সবার একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও শ্রম। দেশের এমন অসংখ্য সফল কৃষি উদ্যোক্তার মধ্যে হ্লাশিং মং চৌধুরীও আমাদের সময়ের নায়ক। কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক’-এ ভূষিত হয়েছেন তিনি।

মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক