বাংলাদেশে প্রথম কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে আজ বুধবার। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করার পর প্রিজন ভ্যানে করে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
বাংলাদেশে প্রথম কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে আজ বুধবার। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করার পর প্রিজন ভ্যানে করে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ

আসামির কাঠগড়ায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের ৪৫ মিনিট

সকালে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আদালতে আনা হয়। সকাল ৯টার দিকে তাঁকে রাখা হয় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায়। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে নয়টার আগে হাজতখানার ভেতর থেকে এ বি এম খায়রুল হককে বের করা হয়। এ সময় তাঁর মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।

হাজতখানার ভেতর থেকে হাঁটিয়ে আদালতের ভেতরের একটি সরু রাস্তা দিয়ে খায়রুল হককে নিচতলায় সিঁড়ির সামনে আনা হয়। পরে দুজন পুলিশ কনস্টেবল সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের হাত ধরে রাখেন। তিনি হেঁটে হেঁটে নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠেন। পরে দোতলা থেকে আবার হেঁটে হেঁটে তিনতলায় ওঠেন। পরে তাঁকে নেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ায়। তখন সময় সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট। নিজের দুই হাত পেছনে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। তখনো বিচারক আদালতকক্ষে আসেননি। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তখন দেখা যায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকাতে থাকেন। কিছুক্ষণ দেখার পর আবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে আদালতকক্ষে আসেন ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মো. ছানাউল্লাহ। এ সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা এ বি এম খায়রুল হকের নাম ধরে ডাকেন।

তখন রায় জালিয়াতির অভিযোগে করা শাহবাগ থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খালেক মিয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন। এসআই খালেক মিয়া আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে একটি সংক্ষিপ্ত রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। সেই সংক্ষিপ্ত রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক মতপ্রকাশ করেন যে পরবর্তী ১০ম ও ১১তম সংসদ নির্বাচন দুটি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বলেও সংবিধান সংশোধনের জন্য মত দেন। ওই সংক্ষিপ্ত আদেশটি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আদেশের পক্ষে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি), সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি) মত দেন। তবে আপিল বিভাগের বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। অর্থাৎ আপিল বিভাগের এই তিন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ মর্মে ঘোষণার বিপক্ষে মত দেন।’

প্রিজন ভ্যানে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। আজ বুধবার ঢাকার আদালত এলাকায়

এসআই খালেক মিয়া আদালতকে আরও বলেন, ‘রায়ের ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ইচ্ছাকৃতভাবে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতিমূলক বিদ্বেষাত্মকভাবে সংক্ষিপ্ত আদেশ উপেক্ষা করে আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দুর্নীতিমূলক ও বিদ্বেষাত্মক পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর দিয়ে রায় প্রকাশ করেন।’

রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, যেহেতু আপিল বিভাগের উক্ত সংক্ষিপ্ত আদেশে উল্লেখিত পরবর্তী দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন দুটি হতে পারে বলে মতামত পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন মামলার আসামি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। মামলার আসামি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্নীতিমূলক, বিদ্বেষাত্মক ও বেআইনি রায় দেন। তিনি অসত্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে এ রায় প্রকাশ করেন।’ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান আদালতকে আরও বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি একটি ফেব্রিকেটেড রায় প্রকাশ করেছেন।’

পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান যখন আদালতকে এ কথা বলেন, তখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘দিজ স্টেটমেন্ট ইজ নট কারেক্ট।’

সাবেক প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের পর পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান আদালতকে বলতে থাকেন, ‘মাননীয় আদালত, আমরা জানি হাকিম নড়ে কিন্তু হুকুম নড়ে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি মামলার আসামি এ বি এম খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত রায়ে যা বলেছিলেন, এর ১৬ মাস পর দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং তিনি রায় টেম্পারিং (জালিয়াতি) করেছেন।’

আসাদুজ্জামান আদালতকে আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, রায়ের কারণে তিনটি প্রজন্ম ভোট দিতে পারেনি। ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে ১৫ শর বেশি ছাত্র-জনতাকে নির্বিচার গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র–জনতা আজ পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।’

পরিদর্শক আসাদুজ্জামান আদালতকে আরও বলেন, ‘কেন মামলার আসামি সাবেক প্রধান বিচারপতি রায় টেম্পারিং করেছিলেন, এই টেম্পারিংয়ের সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত, সেটি জানার জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’

পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক (দিদার) সাবেক প্রধান বিচারপতির রিমান্ডের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এ দেশকে ফ্যাসিজমের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি সংক্ষিপ্ত আদেশে যা বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তার কিছু রাখেননি। তিনি রায় জালিয়াতি করে বিচার বিভাগকে অসম্মানিত করেছেন, কলঙ্কিত করেছেন। শেখ হাসিনা যে ফ্যাসিস্ট, তার প্রধানতম কারিগর হলেন এই সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক।’

এরপর সাবেক প্রধান বিচারপতির রিমান্ডের সপক্ষে আরও যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকার সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) শামসুদ্দোহা (সুমন)। তিনি আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনার সামনে কাঠগড়ায় যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। তাঁর হাতে হাতকড়া পরানো থাকে। তিনি বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করেছেন, অসম্মানিত করেছেন। তিনি রায় জালিয়াতি করেছেন।’

আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করার পর প্রিজন ভ্যানে করে এ বি এম খায়রুল হককে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আজ বুধবার ঢাকার আদালত এলাকায়

শামসুদ্দোহা আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এই সাবেক প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশে ফ্যাসিজমের জন্ম দিয়েছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের থেকেও আওয়ামী লীগের পক্ষে বেশি কাজ করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাঁকে আমরা ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছি।’

শামসুদ্দোহা যখন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ একের পর এক আদালতকে শোনাতে থাকেন, তখন খায়রুল হক মাথা নিচু করে এসব বক্তব্য শুনতে থাকেন।

এ পর্যায়ে শামসুদ্দোহা বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি কেন সংক্ষিপ্ত আদেশকে উপেক্ষা করে ১৬ মাস পর জালিয়াতপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছিলেন, জালিয়াতির সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত, সেটি জানার জন্য এই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে নিবিড়ভাবে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’

পিপির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর আদালত রিমান্ডের আদেশ দেন। বিচারকের পাশে দাঁড়ানো একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আসামি এ বি এম খায়রুল হকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।’

আদালতের এই আদেশ শোনার পর কাঠগড়ায় মুখ ভার করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।

পরে বিচারক এজলাস ত্যাগ করলে এ বি এম খায়রুল হকের কাছে আসেন দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। তখন খায়রুল হকের মাথায় পরানো হয় পুলিশের হেলমেট। কাঠগড়ায় খায়রুল হক প্রায় ৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে তাঁকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালতের তিনতলা থেকে হাঁটিয়ে নিচতলায় নিয়ে আসা হয়। পরে আবার তাঁকে রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়।

এর ঠিক ৩০ মিনিট পর বেলা ১১টার দিকে একটি প্রিজন ভ্যান হাজতখানার ভেতরে ঢোকে। সেই প্রিজন ভ্যানে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে তোলা হয়। দেখা যায়, খায়রুল হক প্রিজন ভ্যানের ভেতরে এক কোণে লোহার বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন। নির্বিকার সাবেক প্রধান বিচারপতিকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি মুহূর্তের মধ্যেই আদালত চত্বর ত্যাগ করে চলে যায়।