
পুলিশি রিমান্ডের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় একটি সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স (পদ্ধতিগত সহিংসতা)। আইন অনুযায়ী এখতিয়ার না থাকলেও বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি স্বীকারোক্তিই নির্যাতন করে আদায় করা হয়। এ পরিস্থিতির সমাধানে শুধু আইন ও কিছু এজেন্সি করলেই হবে না, দরকার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি: ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রক্রিয়াগত সহিংসতা হিসেবে পুলিশি রিমান্ড’ শিরোনামে এই সেমিনারের আয়োজন করে ‘ডি–কেইজ ইনিশিয়েটিভ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
সেমিনারে প্রধান বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান। ফৌজদারি আইনবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, পুলিশ রিমান্ডের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় একটি ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। আইন অনুযায়ী অভিযুক্তকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো এবং কোনো অবস্থাতেই নির্যাতন করার এখতিয়ার নেই। এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার।
কিন্তু বাস্তবতা আর সংবিধানের মধ্যে তফাৎ রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, এসব বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বাহিনী ও দায়িত্বশীল পুলিশ রিমান্ডের বিষয়টা অস্বীকার করে; কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে রিমান্ড মানেই পুলিশি নির্যাতন। এ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আর সরকারের ভাষ্য মিলে যায়।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে ভলান্টারি (স্বেচ্ছায়) বলে সত্যায়ন করলে আদালত সেই স্বীকারোক্তিকে সত্য বলে ধরে নেন। তখন আসামিকে প্রমাণ করতে হয় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য নয়। তিনি বলেন, একজন আসামি তার শাস্তি জেনেও স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করবে কেন, কখন করবে? এটা সম্ভব দুটি কারণে—অপরাধবোধ ও শাস্তি হ্রাস। বাইরের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অপরাধ স্বীকার করলে শাস্তিও সেই অনুযায়ী কমে। অথচ বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই।
১৬৪ ধারা কোনো বাইবেল নয়—এমন মন্তব্য করে এই ফৌজদারি অপরাধবিশেষজ্ঞ বলেন, দেখা যায় যে পুলিশের হেফাজতে যাওয়া ছাড়া কারও বিবেক জাগ্রত হয় না। প্রায় প্রতিটি স্বীকারোক্তিই নির্যাতনের ভিত্তিতে আদায় করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব এই ব্যাপারগুলো দেখভাল করা। সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটিকে অস্বীকার করে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে। বিচার বিভাগও জানে, পুরো প্রক্রিয়াটা সিস্টেমেটিক ডিনায়াল অব ভায়োলেন্স (সহিংসতাকে পদ্ধতিগতভাবে অস্বীকার)।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, হেফাজতে নির্যাতনের দায় পুলিশের চেয়ে বেশি বিচার বিভাগের। অনেক দেশেই কনভিকশনের হার ৯০ শতাংশ। আমাদের এখানে কনভিকশনের প্রকৃত হার ১০ শতাংশের মতো। তার ওপর কনভিকশন ম্যানুফেকচারিং করা হয়, যদি নির্যাতন করে কিছু কনভিকশন বাড়ানো যায়!
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতাকে আবার গৌরবান্বিত করা হয় বলেও অভিযোগ করেন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। সামগ্রিক এই পরিস্থিতির সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট ‘কুলিং পিরিয়ড’ পার না হওয়া পর্যন্ত স্বীকারোক্তি নেওয়া যাবে না—এটা একটা ভালো প্রস্তাব। তবে তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ সংস্কার দরকার আমাদের, শুধু আইন ও কিছু এজেন্সি করলেই হবে না। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের দরকার সহিংসতামুক্ত জুরিসপ্রুডেন্স (আইনশাস্ত্র) ও রাজনৈতিক ডিসকোর্স। এগুলো করলে নতুন আইন ছাড়াই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
সেমিনারে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেন বলেন, অতিরিক্ত কাজের চাপ ন্যায়বিচারের পথে একটি বড় বাধা। যেমন ঢাকার ৫২টি থানায় ম্যাজিস্ট্রেট ৩৭ জন। জনবল এত কম থাকায় সব মামলায় যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব হয় না তাঁদের পক্ষে। পাশাপাশি রাজনৈতিক লবিং ও চাপ, দুর্বল প্রসিকিউশন—এসবও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া দেশে ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশনের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অধিকাংশই কার্যকারিতার দিক থেকে যথেষ্ট দুর্বল।
ঢাকার সিএমএম আদালতের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুলিশের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে স্বীকারোক্তি নিতে পারলেই সে সফল। ১৬৪ ধারা কোনো বাইবেল নয়। এই ধারার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া উচিত।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা, মানবাধিকারকর্মী মুশফিক জোহান, আইনজীবী জহিরুল ইসলাম মূসা, ২০০৫ সালে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার আনোয়ার শংকর প্রমুখ বক্তব্য দেন।