ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে উসাইদ মুহাম্মাদের আঁকা একটি গ্রাফিতি। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে উসাইদ মুহাম্মাদের আঁকা একটি গ্রাফিতি। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর

সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা ও সাহস

যুদ্ধের প্রথম শহীদ নাকি সত্য। গত বছর জুলাই–আগস্ট মাসে দেশে যুদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু এক যুদ্ধাবস্থার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তার দুটি পক্ষ ছিল বাংলাদেশেরই সরকার আর নাগরিক। তীব্র উৎকণ্ঠিত সেই সময়ে সঠিক তথ্য আর বস্তুনিষ্ঠ খবরই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে মহার্ঘ। রাজপথে আর অলিগলিতে প্রতিবাদী লড়াইয়ে লিপ্ত ছাত্র–জনতাকে শেখ হাসিনার সরকার তখন নানাভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। তারা একদিকে চালিয়েছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ, অন্যদিকে করেছে তথ্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা। সেই চরম নিষ্পেষণের দিনে, তথ্যের নিষ্প্রদীপ গোধূলিতে প্রথম আলো হয়ে উঠেছিল বহু মানুষের জন্য আলোকরেখার মতো।

রক্ত আর মৃত্যুতে খচিত সেসব দিনে যাঁরা জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছেন, তাঁদের অনেকে এক গোপন আস্তানা থেকে আরেক গোপন কুঠুরিতে যাওয়ার পথে কিংবা গোয়েন্দা হেফাজতে অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্তি পেয়ে রাস্তায় নেমেই হাতে তুলে নিয়েছেন প্রথম আলো, যথাযথ খবরটির খোঁজে। আন্দোলনকারীদের নানা লেখা বা বক্তব্যে এসব গল্প আমরা শুনেছি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় নির্ভরযোগ্য খবরের জন্য প্রথম আলো হয়ে উঠেছিল বহু মানুষেরই ভরসা।

এই পটভূমিতে যথাযথ খুঁটিনাটি তথ্যের জন্য প্রথম আলো ব্যাপক সংখ্যায় প্রতিবেদককে যুক্ত করে। সারা দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেন বাদ না পড়ে, তার জন্য আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

দেড় দশক ধরে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করে রাখার জন্য শেখ হাসিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ। আর এর সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছিল প্রথম আলো। ছাত্র–জনতার তুমুল আন্দোলন প্রথম আলোর সামনে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও নৈতিকতা রক্ষার বিপুল চ্যালেঞ্জটি সাহস ও পেশাদারত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করার সুযোগ এনে দেয়।

আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের তৎপরতাও বাড়তে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা গণমাধ্যমগুলোকে নিবিড় নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। ফলে বেশির ভাগ পত্রিকাই নিয়মিত সব খবর দিতে পারত না। সম্প্রচারমাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছিল কার্যত সরকারের মুখপত্র; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ যেমন হয়ে উঠেছিল, তেমনই ছিল অপতথ্যেরও বড় উৎস। সরকারের নিবিড় গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা অনেক সময়ই থাকতেন গোপন আশ্রয়ে এবং পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। সে কারণে আন্দোলনের কোন কর্মসূচি যে কোত্থেকে আসবে, তা–ও ছিল অনিশ্চিত।

এই পটভূমিতে যথাযথ খুঁটিনাটি তথ্যের জন্য প্রথম আলো ব্যাপক সংখ্যায় প্রতিবেদককে যুক্ত করে। সারা দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেন বাদ না পড়ে, তার জন্য আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

একাধিক সূত্র থেকে তথ্য নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা প্রথম আলোর ছিল। প্রথম আলোর ওপরে বিশেষ করেই চাপ ছিল। কিন্তু ইতিহাসের সেই কঠিন সময়ে প্রথম আলো সাহস ও যত্নের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে গেছে।

১৬ জুলাই থেকে সরকারের বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা শুরু হয়। অগণিত ছাত্র–জনতা আহত হন। এদিন রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হলে মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন নতুন দিকে মোড় নেয়।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন

প্রথম আলো এই সময়ে আন্দোলনের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়—প্রতিটি মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা এবং নিয়মিত তা প্রকাশ করে যাওয়া, মারণাস্ত্রের আঘাতে হাত–পা–চোখ হারানো মানুষের তথ্য নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন করা, নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে মানবিক প্রতিবেদন করা, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নির্যাতন–নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ ইত্যাদি। মৃত্যুর তথ্য পাওয়া সহজ ছিল না। কারণ, হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা সন্ত্রস্ত ছিলেন। একাধিক সূত্র থেকে তথ্য নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা প্রথম আলোর ছিল। প্রথম আলোর ওপরে বিশেষ করেই চাপ ছিল। কিন্তু ইতিহাসের সেই কঠিন সময়ে প্রথম আলো সাহস ও যত্নের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে গেছে।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি প্রথম আলোর সেই দায়বদ্ধতা ও সাহস পাঠকদের মধ্যে বিপুল আস্থার জন্ম দেয়। প্রথম আলো অনলাইনে সে সময়ের ৩৫ কোটি পেজ ভিউর সংখ্যাই বলে দেয় পাঠকের আস্থা কোন উচ্চতায় উঠেছিল। ১৮ জুলাই সরকার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করে দেয়; বন্ধ করে দেয় সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। পাঠক তখন বস্তুনিষ্ঠ খবরের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায়। পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেড়ে যায় অতিরিক্ত আরও দেড় লাখ।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে গেলে ছাত্র–জনতার দীর্ঘ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে। রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী।

এই পটভূমিতে প্রথম আলো জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের চটজলদি তথ্য সংগ্রহ করার, গণ–অভ্যুত্থানকে বোঝার এবং রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দল নিয়ে মতামত ও নাগরিক বিতর্ক আয়োজনের উদ্যোগ নেয়।

‘বিদ্রোহে–বিপ্লবে’ নামে ২২ আগস্ট প্রকাশিত হয় জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলোর প্রথম ক্রোড়পত্র। কোনো জাতীয় দৈনিকে অভ্যুত্থান নিয়ে ক্রোড়পত্র সেটিই ছিল প্রথম। ‘বিদ্রোহে–বিপ্লবে’ নামে জেলাভিত্তিক আরও চারটি ক্রোড়পত্র বের করা হয়। ২০২৪ সালের ৪ থেকে ৭ নভেম্বর জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলোর আরও চারটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।

এসবের বাইরেও জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলো আরও বেশ কিছু অর্থবহ উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে আছে আন্দোলনের বাছাই ছবি নিয়ে মুক্ত করো ভয় শিরোনামে অ্যালবাম প্রকাশ, প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে শিল্পী শহীদ কবিরের শিল্পকর্ম, আন্দোলন নিয়ে তিনটি তথ্যচিত্র নির্মাণ, এ বছরের ২৪ থেকে ৩১ জানুয়ারি ‘জুলাই–জাগরণ’ শিরোনামে শিল্পকলা একাডেমিতে বিশেষ প্রদর্শনী, গণ–অভ্যুত্থানের তথ্য–ছবি–ভিডিও নিয়ে ওয়েবসাইট উদ্বোধন এবং প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে ছয়টি বই প্রকাশ।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের শক্তি যে দেশবাসী, প্রথম আলোর শক্তির উৎসও যে তাঁরাই—এই ঘটনা আবারও তা দেখিয়ে দিয়ে গেল।