
দেশে ২০২৩ সালের ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮২ জন নিহত হয়েছেন।জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নৈরাজ্য এবং সংঘাত লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিট ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও গত ১১ মাসে (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। সরকারের অনেক ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও এ সময় আইনের শাসন, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা এবং নারীর অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত ১১ মাসে ৮০৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৮২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৮ হাজার ১৫০ জন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল এবং বিএনপির পদযাত্রা ও সমাবেশ এবং আওয়ামী লীগের পাল্টা শান্তি সমাবেশকে কেন্দ্র সংঘর্ষে অধিকাংশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে ৮ হাজার ২৬৩ জন রাজনৈতিক নেতা গ্রেপ্তার হন। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৩৩টি মামলায় ১৩ হাজার ৮০৮ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৫৮ হাজার ১৮৯ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।
এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বারা বিরোধী দলের ৩৫৫টি সভা-সমাবেশ আয়োজনে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩ হাজার ২৫৯ জন আহত হন। গ্রেপ্তার হন ৫ হাজার ৭৮৪ জন। নির্বাচনী সহিংসতার ৬৯টি ঘটনায় ৪ জন নিহত ও ৫৩৭ জন আহত হয়েছেন।
এইচআরএসএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৮টি হামলার ঘটনায় ২৭৫ জন সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই সময়ে ২ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৭৪ জন। একই সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ ও সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩-এর অধীনে করা ৫৮টি মামলায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে ১৮৮ জনকে।
এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ২৫টি হামলার ঘটনায় ৯৯ জন আহত, ১৭টি মন্দির, ৩১টি মূর্তি ও ১২৬টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত মার্চে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় ১ জন নিহতসহ ৬০ জন আহত হয়েছেন।
১১ মাসের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ৩১টি ঘটনায় তথাকথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও নির্যাতনে ১৪ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ৫ জন। আর কারা হেফাজতে মারা গেছেন আরও ৭০ জন।
এই সময়ের মধ্যে ২ হাজার ২৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৪২ জন, যাঁদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ৫৩৫ জন বা ৫৬ ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। আর ১৭৭ জন; অর্থাৎ ১৯ শতাংশ গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪০ জনকে। এ ছাড়া যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় ৬৮ জন নারী নিহত, ৫৮ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও ৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। না হলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। তাই হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানায়।